এই ব্লগটি সন্ধান করুন

জ্ঞানচর্চা এবং আমাদের মানসিকতা


জ্ঞানচর্চার স্পৃহা কখনও কখনও ‘অপরাধ’ হয়ে ওঠে। প্রচল রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে ওই ব্যক্তি শত্রু হয়ে ওঠে, যে কিনা কেবলই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়ায়, কেবলই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায় সব কিছুকে। অথচ ব্যক্তির সেই স্পৃহা হয়ত জেগে ওঠে অন্তর্গত নিষ্পাপ বিহ্বলতা থেকে। জাগতে পারে অসহায় বিস্ময় ও ক্রন্দন থেকে। যেমন জেগেছিল আরজ আলী মাতুব্বরের ভেতর। সে ঘটনা সকলেরই জানা। ‘মাকে আমি আর কোনওদিনই দেখতে পাব না! মিশে যাবেন তিনি মৃত্তিকার ভেতর!’ হয়ত এমনই এক প্রতিকারহীন কষ্ট থেকে মাতুব্বর ১৩৩৯ সনে তাঁর মৃত মার ছবি তুলেছিলেন এক আলোকচিত্রীকে নিয়ে এসে। কিন্তু তাতে বেঁকে বসে সমাজের কর্তাব্যক্তিরা।কারণ ছবি তোলা তো ধর্মে নিষেধ। তার ওপর নারীর – মৃত নারীর! তাঁর মার জানাজা আর দাফন করেনি তারা। কয়েকজন নিকটাত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ী নিয়ে মায়ের শবদেহের সৎকার করেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই সত্যের অনুসন্ধানে একাগ্র মাতুব্বরকে সমাজপতিদের সংস্কার, যুক্তি ও বুদ্ধিহীনতা অস্থির করে তোলে। এ ঘটনায় হৃদয়-মনন জুড়ে যে আলোড়ন ওঠে, তাই তাঁকে নিয়ে যায় নিরাসক্ত জ্ঞানচর্চার দিকে। এরপর তাঁকে আর ফেরানো যায়নি সে-পথ থেকে। দীর্ঘ ১৮ বছর জ্ঞানসাধনার পর তিনি তাঁর সত্যানুসন্ধান নিয়ে মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। সে কথা জেনে ১৩৫৮ সনের ১২ জ্যৈষ্ঠ বরিশাল শহরের তদানীন্তন ল-ম্যাজিস্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির এফ. করিম তাঁকে জামাতভুক্ত করার জন্যে সদলে তাঁর বাড়িতে তসফির নেন। মাতুব্বর তাঁকে বলেন ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান এই তিন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়ের চিন্তা করতে গিয়ে তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি সেগুলোর উত্তর খুঁজছেন। তবলিগ জামাতের আমির যদি তাঁকে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তা হলে তিনি জামাতে শরীক হবেন। এফ. করিম তাঁর কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। তবে প্রশ্নগুলোর লিখিত তালিকা নিয়ে যাওয়ার সময় বলেন, ‘কিছুদিন পরেই এর উত্তর পাবেন।’ কয়েকদিন পর তিনি ‘কম্যুনিজমের অপরাধে একটি ফৌজদারি মামলার ওয়ারেন্ট’ পেলেও আর উত্তর পাননি। কারাগারে যেতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেখানে আটকে রাখা যায়নি তাঁকে। আদালতে তিনি যে জবানবন্দি দেন তার শিরোনাম ছিল ‘সত্যের সন্ধানে’। আদালত তাঁকে মুক্তি দিলেও নির্দেশ দেন, ‘সত্যের সন্ধানে’ কখনও প্রকাশ করতে পারবেন না তিনি। মাতুব্বর তাঁর সে গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন স্বাধীন বাংলাদেশে, ২২ বছর পরে।
এরকম আরজ আলী মাতুব্বর একজন নন। জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হওয়ার উদাহরণ আমাদের এ দেশের নিকট-দূর অতীতেও অনেক অনেক পাই। ব্যক্তির জ্ঞানচর্চার পরিপ্রেক্ষিত রচিত হয়েছে সুদূর অতীত থেকে – তাই নিগৃহীত ও নির্যাতিত হওয়ার, প্রাণ পর্যন্ত দেওয়ার ইতিহাসও অনেক আগের। অথচ সমাজই মানুষের মধ্যে এ ধারণা গেঁথে দিয়েছে, জ্ঞানচর্চার মধ্যে দিয়ে মানুষের উত্তরণ ঘটতে থাকে, যতই সে চর্চা করে, ততই সে বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু মানবসমাজ তার শৈশব থেকেই কখনও নীরবে, কখনও-বা সরবে একটি সামাজিক জ্ঞানের ধারাও পুনরুৎপাদন করে চলে – যা শর্তহীনভাবে আত্মস্থ করতে হয় প্রত্যেককে, যা সমাজকে রক্ষা করে বিদ্রোহ-উপপ্লব থেকে, প্রশ্নহীন ও শর্তহীন আনুগত্যের বন্ধনে বেঁধে রাখে। প্রচল রাষ্ট্র ও সমাজ সব সময়েই চায়, যে-সামাজিক জ্ঞানের বিস্তার ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার চাদর তৈরি করা হয়েছে, নিরুপদ্রুব ও সুরক্ষিত করা হয়েছে শাসনব্যবস্থাকে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন প্রশ্নবিদ্ধ না করে, সংশয়াচ্ছন্ন না করে সেই জ্ঞানকে। প্রতিটি রাষ্ট্র ও সমাজেই তাই একদিকে পরম আনুগত্যশীল ভাবাদর্শ আর নিরেট ব্যবহারিক জ্ঞানচর্চার আয়োজন করে ব্যক্তিকে বেঁধে রাখে। এই আয়োজন এত বিশাল, এর প্রলোভন এত ব্যাপ্ত যে সবাইকে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু তার পরও ব্যক্তির জিগীষা, গোষ্ঠীগত অসাম্যের নিগড়ে বাঁধা অবস্থান, সামাজিক ও ধর্মীয় শাসন-অনুশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট সময় তার সামনে অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে আসে। অথবা এসবের কোনও কিছুই নয় – বিপুলা অনন্ত এ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বালকের মতো অন্তহীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরে সে। সমাজ ব্যক্তিপর্যায়েই সে জ্ঞানের অন্বেষণকে থামিয়ে দিতে চায়, অথবা তার ব্যবস্থার মধ্যেই সে অন্বেষণকে আত্মস্থ করে ফেলতে চায়। কিন্তু তবুও কোনও কোনও ব্যক্তি বেরিয়ে আসেন জ্ঞানচর্চার পথে। অর্থনীতি আর সমাজ-সংস্কৃতির অগ্রগমনই অনিবার্য করে তোলেন তেমন ব্যক্তির আগমণ। এতই সদিচ্ছা, নিষ্পাপ বিহ্বলতা আর অনিবার্যতা থাকে তাঁর উত্তর খুঁজে বেড়ানোর মধ্যে যে জীবনকে বিপন্ন করে তোলাও তুচ্ছ মনে হয়।
এই সদিচ্ছা আর নিষ্পাপ বিহ্বলতার প্রসঙ্গেই মনে আসে জালাল-গীতির জন্য প্রসিদ্ধ লোকগীতিকার ভূস্বামী জালাল উদ্দীন খাঁর কথা। ময়মনসিংহের আশুজিয়া ইউনিয়নের সিংহেরগাঁওয়ে বাড়ি তাঁর। ভূস্বামী মানুষ, নিজেকে আবাদ করতে হতো না তাঁকে। কিন্তু পরিশ্রমী ছিলেন, অসংখ্য পরিশ্রমসাধ্য, অনুশীলনজাত কাজ নিজে নিজেই করতেন তিনি। বিশেষত সিদ্ধহস্ত ছিলেন বাঁশজাত কুটির শিল্পের কাজে। ১৯৭২ সালের ৩১ জুলাই ৭৮ বছর বয়সে নিজের বাড়ির মাটির দোতলা ঘরের বিছানায় মারা যাওয়ার সময় তাঁকে তাঁর প্রিয় শিষ্য কিশোরগঞ্জের হাশেম ফকির যে পাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন, সেটি ছিল জালালেরই নিজের হাতে বানানো। নির্বিরোধ গৃহী মানুষ ছিলেন, ধর্মকর্মও করতেন। কিন্তু তবু কী যে অনন্ত জিজ্ঞাসা ছিল তাঁর তা বোঝা যায় মাত্র একটি ঘটনা থেকেই। যে দোতলা টিনের ঘর তিনি নির্মাণ করেছিলেন, সেটি ছিল লালনের সেই আট কুঠরি, নয় দরজার দেহতত্ত্বের দর্শনে তৈরি। গোলাকৃতি আট-চাল, আট কোণ আর নয়টি দরজা ও জানালা তাতে। এই বৈঠকখানায় বসে সংগীত সাধনা করতেন তিনি। সংগীতেই ছিল তাঁর জ্ঞান বা দর্শনের অন্বেষণ। জালালউদ্দিন খাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ আবদুল হাকিম খাঁ তখন আশুজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। মৃত্যুর পর পিতাকে তিনি শরিয়ত অনুযায়ী বাড়ির আঙিনা থেকে খানিক দূরে কেন্দুয়া-নেত্রকোণা বড় রাস্তার পাশে দাফন করেন। এদিকে জালাল খাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সিলেট-ময়মনসিংহ সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শিষ্য-ভক্ত-অনুরক্ত মানুষ আসতে থাকেন তাঁর বাড়িতে। এই পাগল-ফকির গায়কের দল দাবি করতে থাকেন, পরম আরাধ্য গুরুকে কবর থেকে উঠিয়ে জালালের সাধনাস্মৃতিধন্যবৈঠকখানার পাশে আম্রকুঞ্জে নিয়ে আসতে হবে। শরিয়তবিরোধী এ দাবি চেয়ারম্যান হাকিম খাঁ না মেনে ভক্ত-শিষ্যদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। এদিকে ভক্তদের ভিড় বাড়তেই থাকে। পঞ্চমদিনে বিক্ষুব্ধ ভক্ত-শিষ্যরা গুরুর শবদেহ তুলে এনে ভক্তি-অর্ঘ্য দিয়ে নতুন করে সমাধিস্থ করেন গুরুর সাধনার বৈঠকখানার পাশে আমের ছায়ায়। যে জ্ঞানচর্চা জালাল কোনও দ্বন্দ্বের তৈরি না করেই সমাজ-সংসারে বসে করে গেলেন, তাই তাঁর মৃত্যুউত্তর সময়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে। সমাজের প্রচল চিন্তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আলাদা এক পথে উপনীত হয়েছে।
এ ঘটনা এই বাংলাদেশের। কিন্তু এখন বাউল, যাজক আর মঠ-পুরোহিত হত্যার যে যজ্ঞ শুরু হয়েছে তাতে ভিন্ন চিন্তার মানুষ তো বটেই, শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপালনকারী মানুষরাও নির্ভয়ে মরতে পারবেন কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। জ্ঞানচর্চার মধ্যে দিয়ে আত্মোপলব্ধির নতুন স্থানে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা দূরে থাক, মাথা নিচু করে পূর্বপুরুষের ধর্মসাধনা করাও কঠিন এই সময়ে। সেখানেও সঠিক-বেঠিক প্রশ্নে মৃত্যু এসে হানা দিচ্ছে। ভয়ের সংস্কৃতি গ্রাস করছে প্রত্যেককে।

জ্ঞানচর্চা ব্যক্তিই করেন বটে। কিন্তু ব্যক্তি তো সমাজ আর রাজনীতির বাইরের নয় – নতুন যে জ্ঞানের পথ ধরে সে এগোতে থাকে, যে জ্ঞান সে অর্জন করে চলে, তাও তো তার পূর্বজ্ঞান কর্ষণের ধারাবাহিকতাতেই বিকশিত হতে থাকে। তাই সে চর্চার আয়োজন ও প্রকাশ সামাজিক অভিঘাতও তৈরি করতে থাকে। সে চর্চা সামাজিক আর রাজনৈতিক রূপও পেতে থাকে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাদের কি ব্যক্তির কি সামাজিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বড় একটি বিপ্লব ঘটে যায় বেশ কয়েকটি কার্যকারণের মধ্যে দিয়ে। আবুল হুসেন অনেক আগেই ‘শিখা’ জ্বালিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা ও বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকে সামনে নিয়ে আসে। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়ার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বেগবান হয়ে ওঠে নতুন সময়ের স্রোত। ষাটের দশকে প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ এবং কামরুদ্দীন আহমদের ‘Socio Political History’ ইত্যাদি গ্রন্থ তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে, নতুন সমাজমানস গঠনের ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে এবং তা তখনকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরও অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি রবীন্দ্র-নজরুলের চেতনার সম্মিলনে পূর্ববাংলার বাঙালির ব্যক্তিসত্তা নতুন এক রূপ পেতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করে কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলমান বাঙালি ও বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক পথিকৃৎ হিসেবে দাঁড় করানোর যে চেষ্টা চলে, সে চেষ্টা ভেসে যায় তাসের ঘরের মতো। তারা উদ্ভাসিত হতে থাকে নব নব প্রাণে নব নব তানে। কাজী নজরুল ইসলাম বুমেরাং হয়ে দেখা দেন, তাঁর সাহিত্যকর্ম বাঙালিত্বের সাধনাকেই অনিবার্য করে তোলে – কি মুসলমান বাঙালি, কি বাঙালি মুসলমানের সামনে। ‘সমকাল’, ‘পূর্বমেঘ’, ‘উত্তর অন্বেষা’ – এরকম বিভিন্ন পত্রিকা তখন নতুন চিন্তার দরজা খুলে দেয় সকলের সামনে।
ব্যক্তির জ্ঞানচর্চা, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকাশ শেষ পর্যন্ত গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ভয়ের সংস্কৃতির প্রকাশকেও অনিবার্য করে তোলে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের কালচার’ নামের বইটির কথা অনেকেরই মনে আছে হয়ত। আন্তনিও গ্রামসির চিন্তাধারাকে বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, পাকিস্তানবাদী রাষ্ট্রদর্শনের ভাবাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভূত হয় এই গ্রন্থ। প্রকাশ ঘটে ‘মাহে নও’ সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার। বিদ্যালয় পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের পাকিস্তানি ভাবাদর্শে দীক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে পাঠ্যতালিকায় যুক্ত করা হয় ‘পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি’ নামের পাঠ্যবই। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকার ওই পাঠ্যবই তুলে নিতে বাধ্য হয়। জ্ঞানচর্চাকে যখন আর জ্ঞানচর্চা দিয়ে পরাস্ত করা সম্ভব হয় না, প্রক্রিয়া হিসেবে ভাবাদর্শ নির্মাণ যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন নির্দিষ্ট ছকে শাসন পরিচালনাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে; তখন ভয়ের সংস্কৃতিকে দ্রষ্টব্য করে তোলাই শাসক ও প্রথানুগত মানুষদের প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী আবদুল হকের রোজনামচা থেকে আমরা জানতে পারছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ এপ্রিলে তিনি লিখছেন, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে যে পাকিস্তান সরকার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার এক পরিকল্পনা করেছে। মাসের পর মাস ধরে কী সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায়, চিন্তাভাবনা করে ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল তা আমরা অনুমান করতে পারি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র এক পক্ষের মধ্যেই পাকিস্তান সরকারের এ ধরণের পরিকল্পনা করার ঘটনা থেকে। আর এ লক্ষ্যে দ্রুতই গড়ে তোলা হয় আল বদর বাহিনী। কিন্তু থমকে যাওয়ার মতো আরও একটি তথ্য আমরা জানতে পারছি আবদুল হকের সেদিনের ওই বিবরণ থেকে। আর তা হলো, ১৯৬৯ সালেই নাকি (আবদুল হকের ভাষায়, ‘বৎসরাধিককাল আগে’) এরকম একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভাসানী তা জানতে পেরেছিলেন এবং তোয়াহাকে সেটি প্রকাশ করতে বলেছিলেন। যদিও তোয়াহা তা প্রকাশ করেননি। রোজনামচায় লেখা হয়েছে, ‘এই নিয়ে ভাসানী ন্যাপে ভাঙন দেখা দেয়।’ বোধকরি এই ঘটনার বিস্তারিত উদ্ধার করা গেলে বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞানচর্চা পাকিস্তানি শাসকদের জন্য কত বড় হুমকি হয়ে উঠেছিল এবং তারা আরও কত আগে থেকে এরকম একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল তা জানা যাবে।

পাকিস্তানি শাসকদের হটিয়েছি আমরা, প্রতিষ্ঠা করেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রে ব্যক্তির জ্ঞানচর্চায় ভয়ের সংস্কৃতির হস্তক্ষেপ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। বাকশালী একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে দুই দফার জঘন্য সামরিক শাসন কিংবা সেই শাসনের ফাঁকে ফাঁকে কথিত বহুদলীয় শাসনব্যবস্থার আড়ালে সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতাপূর্ণ স্বৈরশাসন এবং নব্বইয়ের দশকে সামরিক জান্তা এরশাদের পতনের পর প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভয়ের সংস্কৃতির প্রসারই হয়ে উঠেছে শাসকচক্রের শাসন ধরে রাখার ও প্রলম্বিত করার প্রধান উপায়। এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ এক দশকের আন্দোলন শুরু ও বিকশিত হয়েছিল মূলত বামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু তা যখন শেষ হলো, বামপন্থী সংগঠনগুলো তখন ছত্রখান হয়ে পড়েছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটেছে, বামঘেঁষা ছাত্র সংগঠনগুলোয় ক্ষয়িঞ্চুতা ভর করেছে এবং ছাত্ররাজনীতির ভরকেন্দ্রে চলে এসেছে প্রথানুগত সরকারি ধারা। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধীআন্দোলনের শুরুতে মধ্যমণি ছিল ডাকসু – যার নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থী ছাত্রনেতারা। আন্দোলন যখন শেষ হল, তখন ডাকসুর হাল ধরলেন কথিত জাতীয়তাবাদী ধারার ছাত্রনেতারা। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ এক দশকে আন্দোলনকারী প্রধান দুটি জোট প্রকাশ্যে ও আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও বরাবরই যোগাযোগ রেখেছেন মৌলবাদীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। বিভিন্ন স্থানে তখন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষত চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর (মূলত বাম সংগঠনগুলোর) ওপর শিবিরের সশস্ত্র আক্রমণ ছিল রোমহর্ষক। এসব ঘটনায় ছাত্রনেতাকর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর লিয়াজোঁতে ছেদ পড়েনি। রাজনৈতিকভাবে জেঁকে বসার সুযোগ পেয়েছে তারা। ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসনের প্রতিভূ এরশাদ ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্মে’ উন্নীত করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট, এমনকি জামায়াতে ইসলামীও তখন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ব্যক্তির জ্ঞানচর্চা এই রাজনীতির ফাঁদে কীভাবে আটকে পড়তে থাকে, তা বোধকরি লেখার অপেক্ষা রাখে না। সামরিক শাসনপরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনামলে এই রাজনীতির ছোবল আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেননা তখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথিত ‘ঐক্যবদ্ধ’ থাকার বালাই চুকেছে সবার। নগ্ন ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকি আমরা।
আজ থেকে ১৫ বছর আগে এ দেশে সামরিক শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটেছে এটি যেমন আনন্দের সংবাদ, ঠিক একইরকম বেদনার সংবাদ হলো যে এমন এক গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা দেখা দিয়েছে, যাতে ‘প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের পথিকৃৎ’ হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর কোনও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের প্রতিদিনকার ঘৃণার শিকার সামরিক শাসকরা যে কাজ করতে সক্ষম হয়নি, আমাদের গণতান্ত্রিক শাসকরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করেছে। ভয়ের সংস্কৃতি যে আমাদের সমাজের অন্তর্দেশে কীভাবে প্রসারিত হয়েছে, তা ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে কথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলে। রেজিমেন্টেড ফোর্সের শাসন নেই, তাই শাসন পরিচালনা করতে এই ভয়ের সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছে মতাদর্শিক, রেজিমেন্টেড শক্তি। এবং এ ক্ষেত্রে, দুর্ভাগ্য হল, সংবিধানকেও শাসকগোষ্ঠী ব্যবহার করছে।
আলোচনার সুবিধার জন্য আবারও একটু পেছনে ফিরি। ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হলো। এভাবে ব্যক্তিমানুষ নয়, তার ধর্মীয় পরিচয়ই সাংবিধানিক বিধিবিধানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। একটি রাষ্ট্রে ব্যক্তি হিসেবে প্রাপ্য অধিকারের ক্ষেত্রে তার ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্যে নিয়ে এসে ও প্রতিবন্ধক করে তুলে সমতার ধারণাকে নাকচ করে দেওয়া হলো। যা আমাদের অনেকে মুখ ফুটে বলেন না সেটি হলো, এর মধ্যে দিয়ে দিয়ে ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ত্বের অসমতার ধারণাকে আমরা বৈধ করেছি।
ব্যক্তির জ্ঞানচর্চার পথ যে সামনের দিনগুলোয় মৌলবাদীদের কারণে আরও বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে এবং এ বিপদ রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রেও ডালপালা ছড়াবে, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময়েই তার আলামত দেখা দিচ্ছিল। অনেকেরই মনে আছে হয়ত, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে একটি সুন্দর ও মানসম্মত শিশু-কিশোরোপযোগী জ্ঞানকোষ ‘জ্ঞানের কথা’ (প্রথম খণ্ড) প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু মৌলবাদীরা এ বইটির বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তোলে। কোষজাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হয়। এই নিয়ম অনুসরণ করে প্রণীত বিশ্বজগতের পথিকৃৎ মনীষাদের ভুক্তি নিয়ে ধর্মান্ধরা ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টা চালায়। শিশু একাডেমি বইটি বাজার থেকে তুলে নেয়। নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ওই সময় শাহেদ আলীর একটি গল্প ‘জিবরাইলের ডানা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শাহেদ আলী তাদের একই পথের পথিক হলেও মৌলবাদীরা তাঁর এ গল্পটি নিয়ে কখনোই খুশি নয়। গল্পটিতে তারা অন্য কিছুর গন্ধ পায়। গল্পটিকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে নীতিনির্ধারকদের বাধ্য করে তারা। মৌলবাদীরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কার্যকর কোনও শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না বলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলগুলো আত্মতৃপ্তিতে ভুগলেও কার্যত তারা ভাবাদর্শগত ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান সংহত করে চলেছে। মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র আমাকে একসময় কথাপ্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, তাঁদের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাকি ‘বিবর্তনবাদ’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এইটা তোমাদের সিলেবাসে আছে ঠিকই, তবে বানর থেকে মানুষ এসেছে – এই গাঁজাখুরি গল্প তোমাদের না পড়লেও চলবে।’ ছাত্রটি বলার চেষ্টা করেছিল, ‘স্যার, বানর তো না – ডারউইন বলেছেন যে…’; কিন্তু শিক্ষক তাঁর কথা শেষ করতে দেননি, বলেছিলেন, ‘ওই বানর, শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটান, মিসিং লিংক – যাই বল না কেন, সব তো একই, না কি? তোমাদের এসব পড়ার দরকার কী? অন্য কিছু পড়, পরীক্ষায় এলে উত্তর দিও না।’
এই হলো আমাদের বিদ্যায়তনের মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা। আর জোট সরকার আমলে বিদ্যালয়গুলোতে আর্ট বা শিল্পকলা বিষয়টি আবশ্যিক হলেও বর্তমান সরকারের শিক্ষানীতিতে সেটি ঐচ্ছিক হয়ে গেছে। কারও কারও মতে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এই ভয় কাজ করেছে, মৌলবাদীরা অযথাই এটিকে ইস্যু করে তুলবে। এরকমভাবে ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তির শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা মৌলবাদের ফাঁদে আটকে পড়তে শুরু করেছে। আর এর একটি দৃশ্যমান রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত ভিত্তি তৈরি হয়েছে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গ যুক্ত করার ফলে। এরশাদের পতনের পর আন্দোলনকারী রাজনৈতিক জোটগুলোর সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলো। অষ্টম সংশোধনীর একটি অংশ, যাতে উচ্চ আদালতের বেঞ্চের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছিল, যার ফলে বিশেষত হাইকোর্টের বিচারক ও আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, সেটি বাতিল হয়ে গেল। কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের অংশটি রয়েই গেল। আরও পরে আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে অষ্টম সংশোধনীও অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু সংবিধানের ধারাবাহিকতা রাখার স্বার্থে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম আবারও সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছে! ফলে সামরিক শাসনামলে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়ে ভয়ের সংস্কৃতিকে ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে ব্যক্তিকে অপদস্থ, নিপীড়িত ও অবদমিত করার যে ভাবাদর্শগত ও আইনগত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেটির ক্ষেত্র ক্রমশই সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর ব্যক্তির জ্ঞানচর্চা এই কথিত ‘গণতন্ত্রের’ মধ্যে থেকেও শ্বাসরুদ্ধ হতে চলেছে। আহমদ শরীফ তাঁর নির্মোহ জ্ঞানচর্চার জন্য সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন। কিন্তু সামরিক শাসনের পতন ঘটার মাত্র এক বছর যেতে না যেতেই ১৯৯২ সালে তাঁর ফাঁসির দাবি তোলা হয়, তাঁকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয় এবং হত্যার হুমকি দিয়ে ত্রাসের সঞ্চার করা হয়। ‘গণতান্ত্রিক’ পরিবেশে তাঁর বিরুদ্ধে আরও উন্মত্ত হয়ে ওঠার কারণ ছিল বোধকরি এরশাদের সামরিক শাসনামলেই ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’-এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে এগিয়ে আসা। কলমকে ব্যবহার করে চিন্তার বিচ্ছুরণ ঘটানো একজন তসলিমা নাসরিনের কথাও জানা আছে সকলের। ১৯৯৩ সাল থেকে তাঁর লেখালেখিকে কেন্দ্র করে তাঁকে হুমকি দেওয়ার শুরু। পরে তাঁর ফাঁসির দাবিও ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালের গ্রীষ্মে তাঁকে বাধ্য করা হয় দেশ ছেড়ে চলে যেতে। সারা দেশে ওই সময় ফতোয়াবাজি যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, প্রধানত নারীরা যার প্রধান শিকার হন, তা আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনাবোধকে এখনও ব্যঙ্গ করে চলেছে। পরে ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে ফতোয়াবাজিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার রায় দেওয়া হয়। কিন্তু সে রায়ের প্রয়োগও থমকে আছে নানা কারণে।
কিন্তু যেখানে অন্ধকার সেখানেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ ফের আলোর জন্য পদযাত্রা শুরু করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, গত দেড় দশক ধরে তা এ দেশের তরুণ-বালকদের পথ দেখিয়েছে। অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতার পাহাড় কেটে, বন্ধুর পথ বেয়ে এই তারুণ্য-কৈশোরদীপ্ত শিক্ষার্থীরা বলতে গেলে নিজেরাই নিজেদের পথ তৈরি করে নিয়েছেন। ইতিহাস পড়েছেন তাঁরা, মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছেন, যুক্তি দিয়ে সত্যকে উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে একাগ্র চিত্তে কাজ করেছেন। দেশপ্রেম যেখান জাগে, সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা যেখানে জাগে, সেখানে জ্ঞানচর্চার সব শাখাতেই বিচরণ শুরু হয়। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির নৈকট্যে এই তরুণরা অপার এক জ্ঞানজগতের সন্ধান পান। তাঁরা নতুন নতুন সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে শিহরিত হন, উত্তেজিত হন নতুন সত্যের আবাহনে। নতুন জ্ঞান অর্জনের অপার বিস্ময়ে তাঁরা যে উচ্চারণ করেন, তাতে অনেকে ভীত হয়ে পড়েন। তাঁরা হয়ে ওঠেন যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে আন্দোলনের প্রধান সারির মানুষ। এর ফলে মৌলবাদীদের আক্রমণের নতুন এক ক্ষেত্রও হয়ে উঠেছেন তারা। কারিগরি বিদ্যার কার্যকারিতা দিয়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষকে সফলভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হলেও তাদের মূল সংকট পশ্চাৎপদ জ্ঞান ও চিন্তাধারায়। তাই সাইবার জগত হয়ে উঠেছে জ্ঞানচর্চার নতুন এক ক্ষেত্র – যেখানে হারতে শুরু করে সহিংসতার ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে মৌলবাদীরা। ব্লগ কী জানা নেই তাদের কারও – কিন্তু ব্লগাররা শত্রু তাদের!
নব্বইয়ের দশকেই সৌদি আরব ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রধানতম মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর আন্তর্জাতিক অর্থপ্রবাহে টান পড়তে শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি আরবকে সমর্থন করতে ব্যর্থ হয়। এর পর সৌদি আরব ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেকার সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলেও নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে বেশ খানিকটা সময় ধরে সৌদি আরব তার রাজনৈতিক সমর্থনকে দেওবন্দ ও ওয়াহাবীপন্থীদের দিকে প্রতিস্থাপন করে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাধান্যশীল ইসলামি দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, যা পুনরুদ্ধার করা এখনও দলটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার অবস্থা এখন আরও করুণ। এই আন্তর্জাতিক ধর্মবাদী রাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন গোপন মৌলবাদী জঙ্গী রাজনেতিক দলগুলো সামনে চলে এসেছে এবং কেবল খুন কিংবা কণ্ঠরোধ করার মধ্যে দিয়ে কথিত ধর্মবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সারা দেশে। ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় হুমায়ূন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এর পরের ঘটনা আরও মর্মান্তিক ও ভয়াবহ। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলনের সময় থেকে একের পর এক ব্লগার হত্যার মধ্যে দিয়ে তারুণ্যের জ্ঞানচর্চার স্পৃহাকে ভীতির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মতবাদকে মতবাদ দিয়ে নয়, চিন্তাকে চিন্তা দিয়ে নয়, বরং জীবন নিয়ে মতবাদ ও চিন্তাধারাকে নিশ্চিহ্ন করার হিংস্র খেলা শুরু হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার একে একটি সীমারেখার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য যে-সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা এই হিংস্র খেলাকে হিংস্রতর করে তুলছে।
এ ধারণা করার সুস্পষ্ট ভিত্তি রয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি ব্লগার হত্যার পেছনেই মৌলবাদী জঙ্গিরা রয়েছে। এইভাবে তা একটি মতবাদিক রূপও পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শাহবাগ আন্দোলনকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়িয়ে শর্তহীন আনুগত্য আদায়ের পথে এগোয়। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম হত্যা করা হয় শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠক আহমেদ রাজীব হায়দারকে। এরপর একের পর এক হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে। অভিজিৎ রায়ের বই ছাপানোর অপরাধে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। মারাত্মক আহত হলেও বেঁচে আছেন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার-লেখক রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিম। আর হুমকির মুখে রয়েছেন অনেকেই। কেউ নিহত হওয়ার পরে, কেউ বিদেশ যাওয়ার পরে আমরা তিক্ততার সঙ্গে মেনে নিচ্ছি, কী নির্দয়তায় ভরে ওঠে আমাদের চারপাশ। প্রতিটি হত্যার ক্ষেত্রেই এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকেও প্রচ্ছন্নভাবে তিরস্কৃত হতে হয়েছে নিহতদের, কারণ ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ করেছে তারা। এভাবে রাষ্ট্র ও সরকার এমন একটি অবস্থান নিয়েছে যা নাগরিকের অধিকারকে কি সাংবিধানিকভাবে, কি নৈতিকভাবে খেলো করে তুলছে। হত্যাকারীদেরই প্রকারান্তরে তাদের কাজের ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে। আর এই ভাবাদর্শের জাল ছড়ানো হচ্ছে যে, আপনার জ্ঞানের স্পৃহা যত সুদূরস্পর্শীই হোক না কেন, আপনাকে সীমিত থাকতে হবে, ঘেরাটোপে থাকতে হবে, আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হবে। আপনার জন্য ভাবার্দশের একটি চূড়ান্ত স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, আপনি জ্ঞানচর্চা করবেন তার অনুগত সত্তা হিসেবে, স্বাধীন কোনও মানবসত্তা হিসেবে নয়।
এই যে গণ্ডি টেনে দেওয়া হয়েছে, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে ও হচ্ছে, আমাদের জ্ঞানচর্চাকে দূর অতীত থেকেই তা সীমিত করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমাদের যাত্রাপরিধি সীমিত হয়ে পড়ছে। ‘ভয়ের সংস্কৃতির প্রাবল্য বোঝা যায় কেবল সমাজে সন্ত্রাসী ঘটনার আধিক্য থেকেই নয়, বরং সমাজে সন্ত্রাসী ঘটনা কীভাবে স্বাভাবিক বলে স্বীকৃতি লাভ করছে, তার থেকেও।’ আমাদের চারপাশে অসংখ্য সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে। আমাদের কাছে তা স্বাভাবিক বলে মনে হতে শুরু করেছে।

মৌলবাদীদের পরিকল্পিত আক্রমণে প্রকাশক দীপন নিহত হওয়ার পর তাঁর বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।’ তা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। কেউই চেষ্টা করেননি একজন পিতার মর্মভেদী আকুতিকে বুঝবার। তবে বেয়াদবি নেবেন না, আবুল কাসেম ফজলুল হকের আরও একটি ঘটনা আছে। যা নিশ্চয়ই অনেকেরই মনে আছে। ১৯৭৮ সালে তিনি শফিউল আলম প্রধানের মুক্তি দাবি করেছিলেন। ৭ ছাত্র হত্যার কারণে প্রধানের বিচারকাজ সামরিক আমল পর্যন্ত চলে এবং প্রধান দোষী প্রমাণিত হন। কিন্তু ওই সময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার দাবি ওঠে। এবং সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক সুবিধা পেতে শেষমেশ প্রধানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছিলেন। তবে তাঁর মুক্তির দাবিতে দেয়া ওই বিবৃতিতে আবুল কাসেম ফজলুল হক স্বাক্ষর করেছিলেন বলে বিশেষভাবে উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কেননা বিবৃতিতে আরও স্বাক্ষর ছিল কবি শামসুর রাহমানের, ড. আবু মাহমুদের, আতাউস সামাদের, শাহরিয়ার কবিরের, মাহফুজউল্লাহ্র। স্বাক্ষর ছিল রাজনীতিক মশিহুর রাহমান, আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান, আমেনা বেগম, ওবায়দুল হক, আসফউদ্দৌলা রেজা, আফসারউদ্দিন, এমাজউদ্দিন সহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের। কী সুন্দরভাবে বিভিন্ন ঘরানার পথিকৃৎ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর ‘শুভবুদ্ধির উদয়’ হয়েছিল। আবদুল হক তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন, তিনি আবুল কাসেম ফজলুল হককে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তা হলে কি শফিউল আলম প্রধান হত্যাকারী নন?’ উত্তর শুনে হক বিস্মিত হয়েছিলেন, বিবৃতিতে কী আছে না দেখেই আবুল কাসেম ফজলুল হক না কি স্বাক্ষর করেছিলেন! অবশ্য ‘এজন্য তিনি খুবই লজ্জিত, এখন ওই বিবৃতির প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হবে না তিনি বুঝতে পারছেন।’ অতএব তিনি আর প্রতিবাদও করেননি। আমরা জানি না, সকলেই তাঁর মতো না দেখেই স্বাক্ষর করেছিলেন কি না। কিংবা না দেখে স্বাক্ষর করার কথা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। নেপথ্যের কাহিনী যা-ই হোক, অনুমান করা যায়, এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের অনেকেই ভয়ের সংস্কৃতির শিকার। এবং গলা চড়িয়ে ওই বিবৃতির সমালোচনা করারও কিছুই নেই; আমরা যে ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি, তাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় কোনও বিবৃতিতে আমাদের যে-কারও নাম থাকাও হয়ত কারও কাছে অস্বাভাবিক মনে হবে না।
সামরিক শাসন একটি ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল। মৌলবাদ একটি ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করে তুঙ্গে তুলেছে। আর তা থেকে নিরাপদে থাকার মোহে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের, জ্ঞানীদের, এমনকি দেশপ্রেমিকদেরও আশ্রয় নিতে হচ্ছে আরও এক ভয়ের সংস্কৃতির পেটে, তা হল – এই সরকারকে বিব্রত করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট এই ভয়ের সংস্কৃতি রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া, হবিগঞ্জে চা-শ্রমিকদের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক জোন নির্মাণ, কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ – এরকম অসংখ্য ইস্যুতে আমাদের পথিকৃৎ বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের মুখে সিলগালা মেরে দিয়েছে। সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের দাবিদার বাংলাদেশ ওলামা লীগ প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সরকারের শিক্ষানীতিকেই ‘ইসলামবিরোধী’ বলতে পারবে, পহেলা বৈশাখের বিরোধিতা করতে পারবে; সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে মৌলবাদের ভয়ের সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করবে। কিন্তু আমাদের জ্ঞানঅন্বেষণকারীরা সেই সরকার বিব্রত হবে বিধায় আমাদের মতো আমজনতার পক্ষে, এ দেশের পক্ষে, এ দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত কথাগুলো বলতে ভয় পাবেন, দ্বিধাগ্রস্ত হবেন! ‘আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি’ কাব্য শোনাবেন।
জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভাল।’ বোধকরি তাই, ভয়ের সংস্কৃতির এই আগ্রাসনে ব্যক্তির জ্ঞানচর্চা নিজে থেকেই অন্ধকারে মুখ লুকাচ্ছে।
লিখেছেন -শহীদুজ্জামান সরকার

perv post
next post

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ