এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বাঙালি এবং লেখকের জীবন


লেখালেখি একটি চর্চা

লেখকের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত তার পরিবারের স্বীকৃতি।এখানে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে-লেখালেখি যে একটি কাজ,অন্য মতোই একটি কাজের, এবং সেই কাজের জন্য মনোযোগ,সময় এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়-এই বোধটা তৈরী হওয়া।লেখালেখিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে নাই বা ধরা হলো।
কিন্তু এটি যে একটি কাজ,এই স্বীকৃতিটা পরিবার থেকে আসা খুব প্রয়োজন।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বান লেখক শেষ পর্যন্ত যে লেখক হয়ে উঠতে পারে না,লেখক জীবন যাপন করতে পারেন না,লেখালেখির জগত থেকে তাদের যে অকাল বিদায় নিতে হয়,তার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।লেখালেখিকে পারিবারিক ভাবে স্বীকৃতি না দেওয়া।দেশের অন্য সব মানুষদের মতোই বেশির ভাগ পরিবারে লেখালেখি একটি নেহাৎ ই শখের জিনিস।তারুণ্য বা অংকুরোদ্গমী যৌবনে যৌনতার চুলকানিরও পেয়ে বসে আমাদের দেশের মানুষদের।তখন তাদের লেখাকে বাবাহা দেয় বাড়ির ভাবীরা,কাকা-জ্যাঠারা,সহপাঠীরা,বা তার কোন প্রেমিক-প্রেমিকাও।কখনো কখনো এমনকি বাবা মাও।তারা সকলেই অবচেতনে,এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে,এই চুলকানি বেশিদিন থাকবে না।কিন্তু যার ক্ষেত্রে থেকে যায়,অর্থাৎ যে বুঝে যায় যে লেখক হওয়াটাই তার ভবিতব্য,সমস্যাটা তার ক্ষেত্রে।কেননা সে যে অপরিবর্তনযোগ্য মানসিক গড়নটা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে,তা তার পরিবারের অন্য কারো কাছে তা বোধগম্য হয় না কিছুতেই।যেসব শখের সাথে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিচিত, যেমন-বাগান করা,ছুটির দিনে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া,সিনেমা থিয়েটার দেখা,বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঝে মাঝে হৈ-হুল্লোড় করা,কাছে দূরে বেড়াতে যাওয়া।
লেখালেখি একটি চর্চা

এমনকি একটু অধটু নেশাভাঙ করা,মায় কালে ভদ্রে মাগীবাজী করা নিয়েও পরিবারের লোকজন তেমন বেশি চিন্তিত হয় না।
লেখালেখিকেও পরিবারের মানুষেরা সেই রকম শখের ব্যপার বলেই মনে করে।লিখবে না কেন-লিখবে।তবে বাপু সব কাজ করার শেষে।মধ্যবিত্তকে যা যা করতে হয়,সেইসব গ্ল্যানিময় দিন যাপনের সবগুলি শর্ত পূরণের পরে,বাড়ির বাজার সওদা করে দেবার পরেই।বিরক্তিকর সামাজিক অনুষ্ঠান গুলোতে অংশ নেবার পর,দাম্পত্য সঙ্গির সাথে মৈথুন সমাপ্ত করার পর তুমি গিয়ে লিখতে বসো।আর সেই লেখার সময় যদি অন্য কারো ঘুমের বা কাজের ব্যঘাত না ঘটে-তাহলে কারো কোন আপত্তি নেই।যতদিন লেখালেখি সেই রকম শৌখিন শখের পর্যায়ে থাকে, ততদিন কারো কোন সমস্যা নাই।

বলাই বাহুল্য পরিবারের এই মানসিকতা তৈরী দিয়েছে সমাজ এবং রাষ্ট্র। আমার ছেলে শিক্ষক বা ডাক্তার,আমার মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট,আমার ছেলে পলিটিশিয়ান,আমার মেয়ে করপোরেট অফিসের চাকুরে,এমনকি আমার ছেলে -পুলিশ বা ঠিকাদার বলতেও কোন অসুবিধে নেই কারো।কিন্তু আমার ছেলে বা মেয়ে লেখক-এমন কথা কাউকে এদেশে কোনদিন বলতে শুনেনি।বা শুনে যাবেও বলে মনে হয় না।সমাজই নির্ধারণ করে দিয়েছে লেখকের পরিচয়ই হবে অন্য পরিচয়ের লেজ হিসাবে।শুধুমাত্র লেখক লেখক হিসাবেই চিহ্নিত করার কোন সুযোগ এই সমাজ দিতে রাজি নয়।দলিল লেখক পরিচয় মেনে নেয়া যায়।
কিন্তু লেখক পরিচয়?
অসম্ভব!

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলছে,এঔ রকম পরিস্থিতিতেও আত্মসমর্পণ করেন না কেউ কেউ।
করেন না বলেই বাংলাসাহিত্য টিকে রয়েছে।
যতটুকু বিকশিত হবার কথা,ততটুকু বিকশিত হয়েছে এবল হচ্ছে।সেই কেউ কেউ-এর দলে একরোখা অশ্বের মতো যে টিকে যায়,সে যে জেদের বশে টিকে থাকছে, তা নয়।বরং সে সত্তার অপরিহার্য অংচ হিসাবে লেখালেখিকে গ্রহন করেছে বলেই এই কাজটি ছেড়ে যেতে পারছে না।অথবা বলা যায়,এটিই তার সত্তার সর্বপ্রধান অংশ।

আবার পরিবারকেও সে ত্যাগ করছে না।অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সে পরিবারের প্রধান উপার্জন কারীও বটে।এটি প্রায়ইশ দেখা যায়।পৃথীবিতে বোধহয় বাংলাদেশেই একমাত্র দেশ যেখানে একটি পরিবারে শুধু একজন উপার্জন করে,আর নয় দশজন মানুষ তার ঘাড়ে বসে খায়।শুধু খায়-ই না একটু এদিক -ওদিক হলেই যার ঘাড়ে বসে আছে তারই বুকে-পিঠে লাথি মেরে চলে।তো এই অবস্থাতেও লেখক নিজের ওপর অর্পিত পারিবারিক সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে চলছে দাঁতে দাঁত চেপে।
এরপরও সকলে তার উপর অসন্তুষ্ট। কেননা,তাদের ধারণা সে যদি লেখালেখির পিছনে অযথা সময় ব্যয় না করতো তবে বারতি উপার্জন এর পিছনে সময় দিতো পারতো।তাদের জন্য আরো বাড়তি স্বাচ্ছন্দ ও বাড়তি বিলািতার আয়োজন করতে পারতো।তার পোষিত রক্ত আত্মীয়রা নিজেদের যোগ্যতার কথা ভাবে না,নিজেরা যোগ্যতা অর্জনের কথা চিন্তা করে না।তারা শুধু বলে,তারা শুধু বলে তোমার মতোই একই পেশায় থেকে অমুক অমুক মানুষ গুলো সম্পদের পাহাড় গড়েছে,তাদের ভোগ বিলাশিতার সীমা পরিসীমা নাই।তাদের তুলনায় আমাূের তুলনা ভিখিরির মতো।তুমি লেখালেখির মতো অদ্ভুতুরে কাজে সময় নষ্ট না করলে আমাদের তাদের মতোই অনেক কিছুই হতো,অনেক বেশি বেশি হতো।তুমি আবার সততা ছাড়বে না।কারণ তুমি বিশ্বাস করো যে লেখকের অসততার ছায়া তার সৃষ্টির মধ্যে মুখ দেখিয়ে দেয়।তুমি বিশ্বাস যে অসৎ ব্যক্তি কোনদিন কোন বড় লেখক বা বড়কোন শিল্পী হতে পারে না।তাই সমস্ত অসৎ কাজ গুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখো এবং সমাজে যারা অসততা বিরুদ্ধে ক্ষীনকন্ঠে আওয়াজ তুলে তাদের পক্ষে সুর মেশাও।ফলে তোমার উপার্জন কমে,এবং শত্রু বাড়ে।আবার দ্যাখো,বিদেশে চাকরি বা নাগরিত্বের সুযোগ পেলেও তুমি ডলার পাউন্ড কামানোস জন্য দৌড়াও না।কারণ হিসাবে বলো যে তুমি বাংলা লেখক।বাংলাদেশের মাটিতে না থাকলে লেখকের অপমৃত্যু ঘটবে।বিদেশে গিয়ে,অন্য দেশ কেউ লিখতে পারে না।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মতো শক্তিমান লেখক পারেনি।শহীদ কাদরীর মতো কবি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছেন।আরো শত শত প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ফুরিয়ে গেছে।

আহা কী এমন লেখক তিনি হয়েছেন!

হতো যদি হু-র-আ-দের মতো কেউ,তাহলেও নাহয় বোঝা যেত।

তার আরো ধনী না হওয়ার জন্য লেখালেখি।তার একগুয়ে সততার জন্য দায়ী তার লেখালেখি।তার তোষামোদ করার অক্ষমতার জন্য দায়ী লেখালেখি।মুখের উপর অপ্রিয় সত্য বলে দেবার অভ্যাস তেরী হয়েছে এই বাজে লেখালেখির জন্যই।মন্ত্রী -এমপি-,আমলা-বিগশট ব্যবসায়ীদের সে মানুষ বলেই গন্য করে না।এই প্রবণতা তৈরীর পেছনের কারনও সে লেখালেখি।
সবচেয়ে ভয়ংকর কথা।
সে মানুষের ভেতর দেখে নিতে পারে।তার চোখের দিকে তাকিয়ে বেশিক্ষণ কথা বলা মুসকিল। এই সর্বনেশে ক্ষমতা অর্জনের পেছেনের কারণও লেখালেখিতে মনপ্রাণ সঁপে দেওয়া।

অতএব লেখকের চারপাশের দেয়াল প্রতিমুহূর্তে আরো বেশি করে চেপে আসতে চায়।তার শ্বাসরোধ করে তাকে বাধ্য-সুবোধ বানাতে চায় সকলেই তার সংবেদনশীলতা এবং সবার জন্য বুকভরা ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তাকে সোস্যাল এবং ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চায় তারা।
এই রকম পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে আত্মহত্যার কথা ভাবে লেখক।তখন তার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস এবং অক্সিজেনের জোগান দিতে এগিয়ে আসে আরেকটি পরিবার।বছরের পর বছর ধরে মানসিক রকৃতপাতের কারণে তার মনের সম্পূর্ণ ভূগোল জুড়ে যে পুষ্টিহীনতা তৈরী হয়,তা এক নিমেষে দূর করে দেয় আত্মার সাথে সম্পর্কিত পরিবারের সদস্যরা।
সেই পরিবার হচ্ছে লেখক পরিবার।
এই পরিবারই তাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচায়। তার জন্য যুদ্ধের রসদ জোগায়।তার জন্য,এবং তার মতো অন্য আরো অনেকের জন্য,অয়োজন করে জীবনের উৎসবের।

বুঝতে পারে তার হৃদয় দিয়ে অনুভব করে সে একা নয়।

লেখক ব্লগারঃশহীদুজ্জামান সরকার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. আমার কষ্টকর ও যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার প্রায় হুবহু প্রতিফলন খুঁজে পেলাম আপনার লেখায় । কমার্শিয়াল বা বাজারী লেখক বাদে যারা মানুষের জন্যে লিখতে চেষ্টা করে তারা আসলে শারীরিকভাবে ভিন্ন মানুষ হলেও মানসিকভাবে অভিন্ন । এই জন্যই এক লেখকরা ভাবনার সাথে আরেক লেখকের ভাবনা মিলে যায় এবং একে অন্যের লেখায় প্রত্যেকের চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় ।

    উত্তরমুছুন
  2. বাঙালির লেখক হয়ে ওঠাটাই সত্যিকার অর্থে একটা যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরাজয় বরণ করেও নিতে হয় অবশ্য।

    উত্তরমুছুন

মুক্তচিন্তার সাথে হোক আপনার পথ চলা।