এই ব্লগটি সন্ধান করুন

ধর্ষণের কারণ পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার বাহাদুরি



সাধারণভাবে অনেকেই মনে করেন ধর্ষণের বিষয়টি যৌনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক নেই। ধর্ষণ আসলে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা ভালো করে বোঝা যাবে যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে। দুনিয়ার সকল যুদ্ধেই ধর্ষণকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যে দুই লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছে, যৌন নিপীড়ন করেছে এর মূল কারণ কিন্তু রাজনৈতিক। কেবল যৌন আকর্ষণ  নিবারণের জন্য তারা এটা করেনি। বাঙালি জাতিকে অপমান করার জন্য, হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য, বাঙালির মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি হানাদারেরা আমাদের শহর-বন্দর-গ্রামে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি এই যৌন সহিংসতা চালিয়েছে। ফলে যুদ্ধের সময়ে চালানো ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতাকে একটা ‘যুদ্ধকৌশল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই যুদ্ধ কৌশলকে আমরা সাম্প্রতিক ইতিহাসেও নানা রাজনৈতিক দাঙ্গা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন করার চেষ্টাতেও ব্যবহার হতে দেখি। এ কারণেই ভোটের পর ভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘু কিংবা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপরও ধর্ষণের অস্ত্র প্রয়োগ করতে দেখা যায়। সম্প্রতি যেমনটা দেখা গিয়েছিল বহুল আলোচিত নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ঘটনাতেও।



কয়েক বছর আগে দেখলাম খুলনায় ৬৫ বছরের এক নারীকে ধর্ষণ করে সেই ছবি সিঙ্গাপুরে ওই নারীর ছেলেকে পাঠানো হয়েছে। যৌনতার কারণে ওই বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করা হয়নি। ধর্ষণ করে ছেলেকে ছবি পাঠানো হয়েছে তার মাকে অপমান করার জন্য, হেয় করার জন্য, প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে। কাজেই ধর্ষণ স্পষ্টভাবেই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত, পুরুষতন্ত্রের পেশিশক্তি, পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের সঙ্গে যুক্ত। পুরুষতন্ত্র প্রমাণ করতে চায় নারী দুর্বল, নারী অধস্তন, নারী ক্ষমতাহীন। আর এটা প্রমাণের জন্যই একটা সহজ পথ হিসেবে এই মানসিকতার পুরুষেরা ধর্ষণের হাতিয়ার ব্যবহার করে। ফলে আমাদের সমাজে কেন এত বেশি ধর্ষণ হচ্ছে তার উত্তরও খুঁজতে হবে আমাদের সমাজ কাঠামোর মধ্যেই। আমরা মনে করি বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোটা খুবই পুরুষতান্ত্রিক। এই সমাজের যে ‘মাইন্ডসেট’ বা ‘মানসিকতা’ সেটা প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক। এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মধ্যেই নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করার, নারীকে দুর্বল প্রমাণ করার, নারীকে অধস্তন করে রাখার ইচ্ছাটা লুকিয়ে আছে। এরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে সমাজে এত বেশি ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায়। আজকাল অনেককে বলতে শোনা যায় আসলে ধর্ষণ আগের চেয়ে খুব বেশি হয়তো বাড়ছে না, কিন্তু ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে আসার পরিমাণটা বাড়ছে। আমি বলব এটা ভুল ধারণা। ধর্ষণ আগেও ছিল, এখনো আছে এবং সেটা বাড়ছেও। কিন্তু একইসঙ্গে দেশের সংবাদপত্র-টেলিভিশন-রেডিও বা গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, সারা দেশে গণমাধ্যমের নেটওয়ার্ক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও অনেক বিস্তৃত হয়েছে, পাশাপাশি ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক নতুন ধরনের সক্রিয়তা আমরা এখন দেখছি। এর ফলে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া আগে যত সহজ ছিল এখন আর সেটা করা যাচ্ছে না। কোনো না কোনোভাবে সেটা প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো মূল ধারার গণমাধ্যমে আসার আগে ফেইসবুকে তা প্রকাশিত হচ্ছে এবং পরে গণমাধ্যমও সেটা প্রকাশ করছে। ফলে ধর্ষণের খবর প্রকাশ সহজ হয়েছে। এছাড়া মানুষের সচেতনতা বেড়েছে, আগে যৌননিপীড়ন বা ধর্ষণের কথা প্রকাশ করতে যে লাজলজ্জা ও ভীতির মানসিকতা কাজ করত সেটা আস্তে আস্তে কমে আসছে। এটাও ধর্ষণের খবর বেশি প্রকাশিত হওয়ার একটা উল্লেখযোগ্য কারণ বলে আমি মনে করি। এটা একটা ভালো লক্ষণ হলেও ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা ধারণা এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া এখনো খুবই সমস্যাজনক।



যেমন ‘ধর্ষিতা’ শব্দটা আমি ব্যবহার করি না এবং চাই যে এই শব্দের ব্যবহার বন্ধ হোক। আমি ‘রেইপ ভিকটিম’-কে ‘ধর্ষণের শিকার’ বলতে চাই। কোনো নারী বা শিশুকে ‘ধর্ষিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্যে তার সম্পর্কে একটা প্রথাগত সামাজিক ধারণা প্রতিষ্ঠার ব্যাপার আছে। ‘ধর্ষিতা’ বললেই মনে হয় যে, তার সম্মানহানি ঘটানো হয়েছে, তার জন্য একটা লজ্জার ব্যাপার হয়েছে। কিন্তু এটা পাল্টাতে হবে। কেননা, যে নারী বা যে মেয়েশিশু বা ছেলেশিশু ধর্ষিত হয়েছে, তাতে তার কোনো অপরাধ নেই, বরং সে এক ভয়ঙ্কর অপরাধের শিকার। তাই অপরাধের শিকার সম্পর্কে কোনোভাবেই কোনো নেতিবাচক ধারণাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বরং অপরাধী বা ‘ধর্ষক’-কে কাঠগরায় তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা উল্টোটাই দেখছি। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘ভিকটিম ব্লেইম’, মানে যে অপরাধের শিকার হলো তাকেই দোষারোপ করা। আমরা দেখব, কেউ ধর্ষণের শিকার হলে শুরুতেই তার চরিত্র হনন করা শুরু হয়ে যায়। কেউ বলে যে, মেয়েটির পোশাক ভালো ছিল না, কেউ বলে যে মেয়েটি কেন এত রাতে একা একা বাইরে বেরিয়েছিল, রাতের বাসে কেন একা যাচ্ছিল, কেউ বলে যে এই মেয়েটার চলাফেরা ভালো ছিল না। এভাবে ধর্ষণের শিকারকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করা হয় এবং ধর্ষকের অপরাধকে জায়েজ করা বা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যখন তিন বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, তখন কি কেউ বলতে পারবে যে তার চলাফেরা ভালো না, পোশাক ভালো না, সে কি ধর্ষক পুরুষকে উত্তেজিত করে ফেলেছে? ফলে এসব সবসময়ই অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা মাত্র। আবার দেখা যাবে সমাজের অনেক নারীও এই একই সুরে কথা বলছেন। এর কারণ আসলে ওই নারীর নিজস্বতা বিকশিত হয়নি কিংবা ধ্বংস হয়ে গেছে পুরুষতন্ত্রের খপ্পরে পড়ে। ওই নারী যে সমালোচনা করছে তা তোতাপাখির শেখানো বুলির মতোই আসলে পুরুষতন্ত্রেরই কণ্ঠস্বর। সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষতন্ত্র যেভাবে নারীকে কেবল যৌনতার বস্তুতে পরিণত করে রাখতে চায়, প্রকৃত ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চায়, নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখতে চায়, ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত ঘটনাতেও নারীরই দোষ খুঁজে ফেরা এই নারীরাও পুরুষের ওই চাওয়ারই প্রতিধ্বনি।



আমাদের সমাজে এই পরিস্থিতির মূল কারণ সমাজে একটা দ্বৈতনীতি ও দ্বৈতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে রাখা। রাষ্ট্র একটা, দেশ একটা কিন্তু এখানে নারী ও পুরুষের জন্য নীতি দুইরকম, ব্যবস্থা দুই রকমের। শিক্ষাদীক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই দ্বৈতনীতির শিকার হচ্ছে। একটা মেয়ে বা একজন নারী নিজের পরিবারে, নিজের ঘরে যেমন এই দ্বৈতনীতির শিকার, তেমনি ঘর থেকে বের হয়ে গণপরিবহন থেকে শুরু করে জনপরিসর-অফিস-আদালত সর্বত্রই নারীরা এই বৈষম্যমূলক দ্বৈতনীতির শিকার। পাবলিক বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে-স্টিমারে উঠতে গিয়ে শুরুতেই নারী একটা বৈরিতার মধ্যে পড়ে। তারপর নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও সেটা একদিকে যেমন খুবই অপর্যাপ্ত অন্যদিকে অনেক সময়ই সেটাও দখল করে থাকেন পুরুষেরা। এরপর আসে নিরাপত্তার প্রশ্ন। এখন সমাজে নারীর জন্য আলাদা করে নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করা হবে কীভাবে। সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে কোথাও কোথাও সেটা করেই যেতে পারে। কিন্তু সেটা তো সমাধান না। এইখানেই আসে ওই পুরুষতন্ত্র। একদল আছেন, যারা শফী হুজুরদের মতো নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে নারীদের শিক্ষাদীক্ষা-কর্মসংস্থান বঞ্চিত করে কেবলই ঘরে আটকে রাখতে চায়। আরেক দল নারীকে লেখাপড়া শেখার সুযোগ দিতে চায় এবং নারীর কর্মসংস্থানও চায়। কিন্তু এরা পুঁজির মালিক হিসেবে গার্মেন্টস থেকে শুরু করপোরেট অফিস, সবখানেই নারীকে একদিকে সস্তা শ্রমিক হিসেবে শোষণ করতে চায়, আরেকদিকে সুযোগ পেলেই নারীকে যৌনসম্ভোগের বস্তুও বানিয়ে রাখতে চায়। অর্থাৎ এই দুই দলের কেউই নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চায় না। দুই দলই যার যার জায়গা থেকে পুরুষতন্ত্রকেই টিকিয়ে রাখতে চায়। ফলে নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে ধর্ষণ সবকিছুর মধ্য দিয়ে এই পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।



এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষের এই ক্ষমতার বৈষম্যের উৎসটা কোথায়। একটা সময় ছিল যখন নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সেটা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়েছে এবং এখন উচ্চশিক্ষাতেও তারা খুবই ভালো করছে। কর্মসংস্থানের বিবেচনায়ও নারীরা অনেক এগিয়েছে। যদিও নারীর ওপর শ্রম শোষণের মাত্রা এখনো অনেক বেশি। আরেকদিকে নারীর গৃহশ্রমের কোনো আর্থিক মূল্য বিবেচনা করা হয় না। অর্থনীতিতে নারীর এই গৃহশ্রমের মূল্য হিসাব করা হচ্ছে না। ফলে জিডিপিতে নারীর গৃহশ্রম অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে এই প্রশ্ন আরও যৌক্তিকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে যে, শিক্ষা ও কর্মক্ষদক্ষতায় অগ্রসর হলেও নারী কেন সমান অধিকার পাচ্ছে না। এর একটা প্রধান কারণ সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া। আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারসহ বিয়ে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনই মেনে চলা হয়। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। অথচ বিভিন্ন সময়ে আমরা সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে আসছি। পাকিস্তান আমলেও আইয়ুব খান মুসলিম ফ্যামিলি কোড সংস্কার করেছিলেন, যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় বিধানের বদলে আধুনিক রাষ্ট্রীয় বিধান বলবৎ করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক হতে চললেও এই বিষয়ে আমরা কোনো অগ্রগতি দেখছি না। ফলে বলা যায় যে, সম্পত্তির অধিকার বঞ্চিত হওয়াটাই নারীর ক্ষমতা বৈষম্যের প্রধান কারণ। যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের মতো ভয়ংকর বর্বরতা থামাতে হলে সবার আগে নারী-পুরুষের ক্ষমতার বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইসঙ্গে শিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোতে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মজীবী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মস্থলে যৌননিপীড়ন প্রতিরোধ বিধিমালা প্রয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে এ বিষয়ে সামাজিক প্রতিরোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।
লিখেছেন -শহীদুজ্জামান সরকার
আগের পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ