এই ব্লগটি সন্ধান করুন

ম্যাক্সিম গোর্কি: সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী বিপ্লবী সাহিত্যধারার কর্ণধার।

                                                                    লিখেছেনঃ-


ম্যাক্সিম গোর্কি ছদ্মনামের আড়ালের অ্যালেক্সি ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ; পিতৃপ্রদত্ত এই নাম মুছে দিয়ে গোর্কি নামেই উত্তরকালে তিনি জগদ্বিখ্যাত হন এবং উনিশ শতকে যে কয়েকজন হাতেগোনা সাহিত্যিক বিশ্বসাহিত্যে ঝড় তুলেছেন ম্যাক্সিম গোর্কি নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যদিও তিনি উপন্যাস এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন, তথাপি তাঁর গল্পগ্রন্থগুলো তাঁকে সত্যিকারের গোর্কি হয়ে উঠতে অসামান্য অবদান রেখেছেন বলেই মনে করা হয়। গল্পের বেশ চমৎকার গাঁথুনিশৈলি এবং স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্মের মাঝেই তিনি নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে রেখে গেছেন। অস্বীকার করার জোঁ নেই যে, শৈশব এবং প্রথম কৈশোরেই বিদ্রোহী এই রুশ ভবঘুরের দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। যে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলো ১১ বছর বয়সে, পরে দাদির আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন, আর আমি পালিয়ে ছিলাম ১২ বছর বয়সে, পরে নানীর আশকারা পেয়ে বেড়ে ওঠেছি। দাদির মৃত্যুর পরে হতবিহ্বল গোর্কি একবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন, আর স্থানীয় সামাজিক অসাম্যের জন্য হতবিহ্বল হয়ে ১৯৯১ সালে আত্মহত্যার ব্যর্থচেষ্টায় অবশেষে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো। যে আমাকে শিখিয়েছিলো, জীবনের প্রকৃত শিক্ষা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পৃথিবীর পথে পথে, পৃথিবীর পাঠশালায়। তারপর থেকে পথ থেকে পথেই আমার পাঠশালা...এই ভবঘুরের দেখানো পথই আমাকে কালের কাফেলায় নীরবে হাতছানি দিয়ে গেছে বেলা-অবেলা।

জারশাসিত রুশসাম্রাজ্যে বহুবিদ্রোহে সরাসরি অংশগ্রহণকারী গোর্কি ছিলেন লেনিনের আজীবন বন্ধু, যাঁকে বেশকয়েকবার কারাবরণ করতে হয়েছিলো। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
তাঁর প্রথম বই, ' অ্যাসেজ অ্যান্ড স্টোরিজ' ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর ভুবন বিখ্যাত উপন্যাস ' মা' বিশ্বজুড়েই সমাদৃত। একে একে প্রকাশিত হয়, আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে, পৃথিবীর পাঠশালায়, ফোমা গর্দেয়েভ, নাটক চিলড্রেন অব সান, দ্য লোয়্যার ডেপথ। তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে সোস্যাল রিয়ালিজম নামে যে নব্য সাহিত্যধারার সুচনা হয়, গোর্কি ছিলেন তার কর্ণধার। প্রথাগত চেনা-পরিচিত সাহিত্য ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হলো তাঁর নতুন পথে যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষেরা- চোর, লম্পট, ভবঘুরে, মাতাল, গণিকা, চাষী, মজুর, জেলে, সারিবদ্ধভাবে ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর রচনায়। এই পর্বের কয়েকটি বিখ্যাত গল্প হলো মালভা, বুড়ো ইজরেগিল, চেলকাশ, একটি মানুষের জন্ম। গল্পগুলিতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠেছে নিচু তলার মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ অন্যদিকে অসাধারণ বর্ণনা, অপরিমেয় কল্পনাশক্তি আর তাঁর অনবদ্য সৃজনশীলতা।

যদিও মা ছেলের সম্পর্কই 'মা' উপন্যাসটির উপজীব্য, তথাপি একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য ক্রমশ তৈরি হতে থাকা রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করার কারণে এই ঔপন্যাসিক বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ স্থান ও প্রশংসার পাবার দাবী রাখেন; যা তিনি ন্যায্যভাবেই পেয়েছেন। "মা" উপন্যাসটির সামাজিক মূল্য এক কথায় অতুলনীয়, একটি উপন্যাস সময়ের আবেদনে একটি জাতির বিবেককে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে, তুমুলভাবে আলোড়িত আলোকিত করতে পেরেছে, এমন উদাহরন বিশ্বসাহিত্যে আর বিশেষ আছে বলে মনে হয় না। পেলাগেয়া নিলভনা নামের একজন অতিসাধারণ 'মেয়েমানুষ' কি করে সময়ের প্রয়োজনে আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হন একজন সমকালীন রাজনীতিসচেতন 'ব্যাক্তি'তে, বুঝতে শেখেন সারাজীবন কী করুনভাবে কাটিয়েছেন শ্রেণীগত নির্যাতন ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের অসহায় শিকার হয়ে; তা চমত্‍কার বর্ণনা করেছেন গোর্কি তাঁর দুর্দান্ত ভাষারীতিতে লেখা কালজয়ী এই উপন্যাসটিতে। ব্যাক্তিগতভাবে পাভেল পারেনি, সাইবেরিয়ার তুষারে তিমিরশীতল নির্বাসন কাল কাটাতে; কিন্তু বারো বছরের মাথায় সমষ্টিগতভাবে বাস্তবায়িত হয় পাভেল ও পাভেলের মতো আরও অসংখ্য সাম্যবাদী যুবকের স্বপ্ন, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র: সোভিয়েত ইউনিয়ন; অগণিত 'মা'য়ের আত্মত্যাগের বিনিময়ে।

ম্যাক্সিম গোর্কি ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ার নিঝনি নভোগরোদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর বাবা ম্যাক্সিম পেশকভের বিশেষ কোন অবদান না থাকলেও মা ভার্ভারা’র অবদানকে কোন অংশেই খাটো করে দেখা যাবে না। যদিও অল্প বয়সে তাঁকে রেখে তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাবার পর মার সাথে এসে আশ্রয় নিলেন মামার বাড়ি নিঝনি নভোগরোদ শহরে। কিছুদিন পর স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করেন। ইতোমধ্যে মা ভার্ভারা তার চেয়ে দশ বছরের ছোট এক অপদার্থকে বিয়ে করেন। পরের বিয়ে মোটেও সুখের হয়নি। এর কিছুদিন পরেই তিনি ক্ষয়রোগে মারা গেলেন। হঠাৎ করে মা মারা যাওয়ায় তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ল দাদার ওপর। কিন্তু বুড়ো দাদামশাই আর শিশু গোর্কির দায়িত্বভার নিতে চাইলেন না। মায়ের শেষকৃত্যের কয়েকদিন পরেই তাঁকে ডেকে বললেন, ‘‘তোমাকে এভাবে গলায় মেডেলের মতো ঝুলিয়ে রাখব তা তো চলতে পারে না। এখানে আর তোমার জায়গা হবে না। এবার তোমার দুনিয়ার ঘাটে বেরুনোর সময় হয়েছে।’’
সেই থেকে শুরু হলো গোর্কির সংগ্রামমুখর নতুন জীবন। শহরের সদর রাস্তার উপর এক সৌখিন জুতোর দোকানের বয়, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। যদিও পরিশ্রমকে তিনি পুরুষের অলঙ্কার স্বরূপ মনে করতেন। একদিন দোকানের চাকরি ছেড়ে দিলেন। জার শাসিত আমলে রাশিয়ায় যাদের নির্বাসন দেয়া হতো, তাদের যেই জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হতো, সেই জাহাজের কর্মচারীদের বাসন ধোয়ার কাজ ছিলো গোর্কির। ভোর ছয়টা থেকে মাঝরাত অবধি কাজ। তারই ফাঁকে ফাঁকে দুচোখ ভরে দেখতেন নদীর অপরূপ রূপ, দুপারের নয়নাভিরাম গ্রামের দৃশ্য। হিসাবপত্র মিটিয়ে একদিন হাতে মাত্র আট রুবল নিয়ে ফিরে এলেন নিজের শহর নিজনি নভোগরোদে।  

বৈচিত্র্যতায় ভরপুর তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে একপেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বড় হয়ে উঠতে থাকেন গোর্কি। সবিছুর মধ্যেও বই পড়ার নেশা বেড়ে চলে, বইয়ের পছন্দেও কোন বাদবিচার ছিল না, সর্বভূকের মতো হাতের কাছে যা পেতেন তাই পড়তেন। একদিন হাতে এল মহান রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই। একনষ্ঠিভাবে পড়লেন এবং পড়তে পড়তে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন।
বিশ্ব যখন অস্থির সময় পার করছিল ঠিক তখন রাশিয়ায় চলছিল জারের রাজত্বকাল। দেশ জুড়ে চলছিল শাসনের নামে শোষণ নীপিড়ন আর অত্যাচার। বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত হয়েই গোর্কি পরিচিত হলেন মার্ক্সের রচনাবলির সাথে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দর্শন, আরো আরো নানান বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করলেন। যদিও দারিদ্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিছুদিন পর একটি রুটির দোকানে কাজ পেলেন, সন্ধ্যে থেকে পরদিন দুপুর অবধি একটানা কাজ করতে হতো। তারই ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন বই পড়তেন।
বাস্তমুখর জীবনের পরতে পরতে তিনি কষ্টকে, পরিশ্রমকে বন্ধুর মতোই নিত্য সঙ্গী হিসেবে দেখেছেন। তাঁর এই সময়কার জীবনে অভিজ্ঞতার কাহিনি অবলম্বনে পরবর্তীকালে লিখেছিলেন বিখ্যাত গল্প ' ছাব্বিশজন লোক আর একটি মেয়ে’। রুটি কারখানায় কাজ করার সময়ই পুলিশের প্রথম সন্দেহ পড়েছিল তার ওপর। যদিও সুকৌশলে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন গোর্কি।

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতে মনের সব শক্তি ফূরিয়ে ফেলেন, তার ওপর যখন সন্দেহ অবিশ্বাস; নিজের ওপরেই সব বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলে ছিলেন। 'এই জীবন মূল্যহীন, বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই।' এই মনে করেই তিনি বাজার থেকে একটি পিস্তল কিনলেন। ১৮৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকে গুলি করলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তাররা জীবনের আশা ত্যাগ করলেও অদম্য প্রাণশক্তির জোরে সে যাত্রায় বেঁচে যায় গোর্কি। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে তিনি যে প্রবাদপুরুষ তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এক বৃদ্ধ বিপ্লবী মাঝে মাঝে রুটির কারখানায় আসতেন, তাঁর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে, সুস্থ হয়ে উঠতেই প্রথমে গোর্কিকে নিয়ে গেলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। ঘুরতে ঘুরতে এলেন নিজের ক্যাসপিয়ান সাগরের তীরে এক ছোট্ট শহরে। পরবর্তীতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমন করেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বেড়ে উঠতে লাগলেন গোর্কি। কোথাও বেশিদিন থাকতে মন চায় না। রেলে পাহারাদারির কাজ নিয়ে এলেন নিজের পুরনো শহর নিজনি নভোগরোদে। এই সময়ে সে কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। নাম দেন ’পুরনো ওকের গান’। দুজন বিপ্লবীর সাথে পরিচয় থাকার জন্য পুলিশ তাকে বন্দী করেছিলো। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে দিল। তারপর প্রায় দুবছর সেখানে রয়ে গেলেন।
পরবর্তীতে কুলঝানি নামক এক ভদ্রলোক তাঁকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় পত্রিকা অফিসে। নিজের নাম সই করার সময় ’আলেক্সই পেশকভ’ এর পরিবর্তে লেখলেন 'ম্যাক্সিম গোর্কি'। গোর্কি শব্দের রুশ অর্থ হল তিক্ত বা তেতো। গল্পটি প্রকাশিত হলো ১৮৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আক্ষরিক অর্থে তিনি তা-ই ছিলেন। তার লেখায় সবসময় ফুটে উঠেছে তিক্ত সত্য। রাশিয়ার জনজীবনের নিঠুর বাস্তবতাকে তিনি কলমের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। অকুতোভয় বীরের মতো জার সম্রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে। এই গল্পে অবশ্য বাস্তবতার চেয়ে রোমান্টিকতার প্রভাবই বেশী ছিলো। ‘এমিলিয়ান পিলিইয়াই’ গল্প পড়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক ভ্লাদিমির গালাক্কিওনচিভচ করলিয়েনক উৎসাহ দেবার পর ’চেলকাশ’ গল্প যখন কাগজে বেরুলো তখন গোর্কিকে তিনি সাংবাদিকতার চাকরির প্রস্তাব দেন: সামারার নামক একটি বড় কাগজে চাকরি, মাস গেলে ১০০ রুবল আসবে। এমন প্রস্তাব পেয়ে হাতছাড়া করেননি, গোর্কিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।

তিফলিস শহর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক কাফকাজ' (ডেইলি ককেশাস) সংবাদপত্রে ১৮৯২-এর ১২ই সেপ্টেম্বর শনিবার একটি গল্প ছাপা হলো : মাকারচুদ্রা। লেখকের নাম ম. গোর্কি। এরপর অনেক পত্রিকায় ক্রমে ক্রমে তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে– যেমন ভোলগা সংবাদপত্র, দৈনিক সামারার, ওদেসা সংবাদ, নিঝগরোদ পত্র ইত্যাদি। ১৯১৫ সালে তিনি নিজেই লিয়েতপিস (কড়চা) পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ১৯২১ থেকে এটি তাঁর সম্পাদনায় বেরুনো শুরু হয়।
তাঁর রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে গেয়র্ক লুকাচ বলেন- ‘‘লেখক হিসাবে গোর্কি সর্বদাই তাঁর সমকালীন ঘটনাবলীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন এবং নিজের রচনার মধ্যে এমন ভেদরেখা টেনে দেননি যাতে কতটুকু একজন সাহিত্যিকের লেখা আর কতটুকু এক বিপ্লবী সাংবাদিক ও প্রচারকর্মীর তা ধরা যায়। সত্য এর বিপরীতটাই। তাঁর মহত্তম সাহিত্যকীর্তি সর্বদা সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করে উত্থিত হয়েছে।


১৯০১ সালে বিপ্লবী অন্দোলন ক্রমেই বেড়ে চলছিল। ১৯০২ সালে লেনিনের সঙ্গে তার দেখা হয়। এরপর তারা ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হন। এ সময় তিনি প্রেসের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কথা বলেন। ওই বছর অনারারি একাডেমিশিয়ান অব লিটারেচার নির্বাচিত হন। কিন্তু জার নিকোলাস দুই তা রদ করেন। এর প্রতিবাদে আন্তন চেকভ ও ভ্লাদিমির করোলেঙ্কো একাডেমি ত্যাগ করেন। গোর্কি তখন সেন্ট পিটার্সবার্গে। কাজানের এক আন্দোলনে অনেক ছাত্র নিহত হলে তিনি লেখেন ‘দ্য সং অব দ্য স্টর্মি পেত্রল’ ‘ঝড়ো পাখির গান’ নামের বিখ্যাত কবিতা। তার এ কবিতা যেন বিপ্লবের মন্ত্র। ক্রমেই গোর্কি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন লেনিনের আদর্শে। এ সময় বহু বিপ্লবী নেতাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তিনি হয়ে উঠলেন জার কর্তৃপক্ষের এক নম্বর শত্রু। আন্দোলন তুঙ্গে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব নিয়ে লেখেন নাটক চিলড্রেন অব সান। নাটকটির প্রেক্ষাপট ছিল ১৮৬২ সালের কলেরার মহামারী। কিন্তু প্রতীকি অর্থ বাদ দিলে এটি উঠে সে সময়ের রাশিয়ার চিত্র। একই বছর তিনি তাঁর বিখ্যাত দ্য লোয়ার ডেপথ (নীচুতলা) নাটকটি লেখেন। এই নাটকের বাণী ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের সর্বত্র। তখন গোর্কির পরিচিতি রাশিয়ার সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি হয়ে ওঠেন ইউরোপের শাসিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
স্ট্যালিনের হাতে ক্ষমতা আসার পরই তিনি ম্যাক্সিম গোর্কিকে বিশেষ সম্মান দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। তাঁর জন্মস্থান নিঝনি নভোগরোদ জেলার নাম বদলে ১৯৩২ সালে এর নামকরণ করেন 'গোর্কি'। ১৯৩২- ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গোর্কি নাম বহাল ছিলো, কিন্তু ১৯৯০-এর পর স্থানটি পূর্বনাম নিঝনি নভোগরোদে ফিরে পায়।
গোর্কিকে আরো সম্মানিত করার জন্য স্ট্যালিন ১৯৩০ দশকে নির্মিত পৃথিবীর সর্ববৃহত উড়োজাহাজের নাম দেন ম্যাক্সিম গোর্কি। স্ট্যালিন পৃথিবীকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন, আকাশযান প্রযুক্তিতে সবার সেরা সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দীর্ঘ রোগভোগের পর, ১৯৩৬সালের ১৮জুন এই রুশ বিপ্লবী সাহিত্যিক মাত্র ৬৮বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই, বিপ্লবী চেতনা তথা বিপ্লবের মাঝেই তারা কালজয়ী অমরত্ব পায়। আজ ২৮শে মার্চ, সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী সাহিত্যধারার এই বিপ্লবীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে, তাঁর বৈচিত্রময় কর্মজীবন, কীর্তিময় সৃষ্টির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ফুলেল শুভেচ্ছা, তথা হ্যাটস অফ স্যালুট এই মহান 'ভবঘুরে বিদ্রোহী'কে, আমি যাঁর বুক পকেট থেকে বেরিয়ে আসার আস্পর্ধাহীন দাবী করি বরাবর-ই।
-ভবঘুরে বিদ্রোহী
২৮ মার্চ, ২০১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ