সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আত্নহনন চিন্তার বিচিত্র প্রক্রিয়া" - আহমদ ছফা





বোধহয় নব্বই সালের দিকে হবে । ঢাকাতে মাওলানা সাহেবেরা একটা মিছিল বের করেছিলেন । ওটাকে খণ্ড মিছিল বলা যাবে না । ওলামায়ে কেরামেরা তো অংশ নিয়েছিলেনই । তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আরও প্রায় হাজার দেড়েক মাদ্রাসার ছাত্র । সকলেই এক হিন্দু ভদ্র লোকের ফাঁসির দাবি করছিল । মিছিলটা দেখে আমার খুব কৌতূহল জন্ম নিয়েছিল । সেই বায়তুল মোকারমের কাছ থেকে পেছন পেছন অনুসরণ করে প্রেসক্লাব অবধি এসেছিলাম । কেন এসেছিলাম তার একটা কারণ আছে সাধারণত মাওলানা সাহেবানরা যখন কারো ফাঁসির দাবি করেন আপনি নির্ঘাত জেনে যাবেন ওই ব্যাক্তিটি হবে মুসলমান । আমার বয়স পঞ্চাশ হল ।ঢাকা শহরে আছি ত্রিশ বছর । এই ত্রিশ বছরে কম করে হলেও মাওলানা সাহেবদের এক শ'টি ফাঁসির দাবির মিছিল দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । প্রতিটা মিছিলেই আমি লক্ষ করেছি মাওলানা সাহেবরা যে হারামজাদাটিকে ফাঁসিতে লটকাবার দাবি জানাচ্ছেন তিনি একজন মুসলিম সন্তান । ফজলুর রহমান , বজলুর রহমান , সালমান রুশদী আহমেদ শরীফ , কবির চৌধুরী কতো নাম করব । মাওলানা সাহেবেরা মাঝে মাঝে কিছু কিছু মুসলিম সন্তানকে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়াবার দাবিতে মিছিল করেন এই ব্যাপারটির সঙ্গে আমি একরকম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম । কিন্তু এই মিছিলটিকে খুবই অবাক হয়ে দেখলাম তাঁরা একজন হিন্দু ভদ্র লোককে ফাঁসিতে লটকাবার কথা বলছে । এই হিন্দু সন্তানের এতো কি সৌভাগ্য যে মাওলানা সাহেবেরা তাঁকে ফাঁসিতে দেয়ার দাবিতে মাঠে নামতে পারেন ? সেজন্য মিছিলটার পেছন পেছন আমি প্রেসক্লাব অবধি আসছিলাম । প্রেসক্লাব এসে আমি শ্মশ্রুহীন একজন মাদ্রাসার ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করি । তার সঙ্গে আমার যে বাতচিৎ হয়েছিল সেটা এখানে বয়ান করি । আমি খুব বিনয় সহকারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম , হজরত , আপনারা কোন হিন্দুর ফাঁসি চাইছেন ? এবং কেন? উনি খুব চেতে গিয়ে বললেন , আপনি এখনো খবর পান নি । আমি অপরাধ স্বীকার করে বললাম , না এখনো খবর টা পাইনি । তিনি জানালেন , এক হারামজাদা হিন্দু আমাদের নবীর নামে খারাপ কথা লিখেছে । তার জন্য ফাঁসি না চেয়ে কি জেল চাইব ? আমি বললাম , জেল চাওয়াটা ঠিক হবে না । ফাঁসি হল আসল জিনিশ । মেহেরবানী করে নামটা বলুন । তালেবে এলেমটি থেমে থেমে বললেন , নগেন্দনাথ , নগেন্দ্রনাথ হওয়াই উচিৎ । তালেবে এলেম রফলাটি উচ্চারণ করতে পারেননি বলেই নগেন্দনাথ হয়ে গেছে। আমি 'নগেন্দনাথ' বলে কোন হিন্দু লেখকের নাম শুনিনি । সুতরাং যাকে চিনিনে-জানিনে এমন মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মাওলানা সাহেবরা যদি নবী করিমের ইজ্জত রক্ষা করতে চান আমার কি এসে যায় । আমি হাঁটতে হাঁটতে পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে এসেছিলাম । লাইব্রেরিয়ান ছিলেন আমার বন্ধু । কথায় কথায় ফাঁসির প্রসঙ্গটি আমি উত্থাপন করি । লাইব্রেরিয়ান সাব আমাকে জানালেন , আপনি জানেন না নগেন্দ্রনাথ বসু অনেকদিন আগে এনসাইক্লপিডিয়া ইসলাম সম্পর্কে অথবা ইসলামের এনসাইক্লপিডিয়া এই শিরোনামে একটি কিতাব লিখেছিলেন । ঐ ভদ্রলোক ১৮৮৪ সালে ইন্তেকাল করেছেন । হালে ঐ কিতাবটি কোলকাতায় নতুন করে ছাপা হয়েছে এবং তা মাওলানা সাহেবদের কারো চোখে পরেছে । তাই এই মিছিল , তাই এতো আওয়াজ , তাই এই নিঃশর্ত ফাঁসির দাবি । মানুষটা বেঁচে আছে কিনা সেটা ভেবে দেখার কথাও কারো মনে এল না । একটি মৃত মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার দাবিতে দেড় হাজার লোক জোগাড় করা , মাইক জোগাড় করা সে কি চাট্টিখানিক কথা বিষয়টি নিয়ে আমি সিরিয়াসলি চিন্তা করতে থাকি । আমাদের দেশের মুখ চেনা ভদ্র লোকেরা এগুলোকে মৌলবাদী ক্রিয়াকাণ্ড বলে চিহ্নিত করতে পারলে দায়িত্বমুক্ত মনে করেন । কিন্তু এরকম সাদা - কালো স্তরবিন্যাস করতে আমার মন চায় না । আমি ভেবে - চিন্তে যে সিদ্ধান্তে এসেছি সেই জিনিসটা নিবেদন করতে চাই । আমাদের ধর্মান্ধ মানুষেরা - তাঁদের মধ্যে কিছু পরিমাণ মোল্লা - মৌলানা আছেন , যে - কোন ছুতানাতায় , পান থেকে চুন খসে গেলে যে - কোন আদম সন্তানকে ফাঁসিতে লটকাতে চান তার কারণ একটিই । এই সমস্ত মানুষের মনে আত্নহননের চিন্তা সব সময় ক্রিয়াশীল থাকে । তাঁদের শিক্ষা - দীক্ষা জাগতিক চাওয়া পাওয়া জগত এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যেই এই মৃত্যুকীটটি লালিত - পালিত হয় । মানুষ সংঘবদ্ধ ভাবে অপরের মৃত্যু যখন কামনা করে , মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এটা এক ধরনের আত্নহননের চিন্তা । যেই মানব বর্গ শয়নে স্বপনে আত্নহনন চিন্তায় বেস্ত থাকে তাঁরা যে কোন হুজুগেই অপরের মৃত্যু কামনায় মেতে উঠতে পারে এবং এটাকে একটা পবিত্র ধর্মীও কর্তবের লেবাস পরাতেও কুণ্ঠিত হন না । প্রফেশনাল মনস্তাত্ত্বিকরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানি না । আমি যখন এক দল লোককে যত্র তত্র ফাঁসির দাবিতে উম্মত্ত হয়ে উঠতে দেখি সেই জিনিশটাকে মানুষের আত্নধ্বংশি প্রবণতার একটা রকমফের হিসেব বলে মনে করি । আসলে তাঁদের নিজেদেরকেই ধ্বংস করার চিন্তা সতত প্রবাহমান । কিন্তু সাহসের অভাবে সেটি করতে পারছেন না তাই অপরের মৃত্যু কামনায় সবান্ধবে এমন মুখর হয়ে উঠতে পারে । দুদিন আগে কাগজে দেখলাম বাবা শাহজালালের পুণ্যভূমি সিলেট শহরের মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল করে সরকারের কাছে ডেডলাইন বেঁধে দিয়েছে । সরকার যদি তসলিমা নাসরিনকে ফাটকে না ঢুকায় এবং ড,আহমদ শরীফ ,প্রোফেসর কবির চৌধুরী এবং পিচ্চি নাস্তিক দ,সাইদুর রহমানকে গ্রেফতার না করেন তাহলে আগামী ১০ কিংবা ১১ তারিখে সিলেট শহর তাঁরা অচল করে দেবেন । আমি সরকার চালাইনে। সুতরাং তসলিমার ভাগ্যে কি ঘটবে আমি জানি না । তসলিমা নাসরিন একটা বই লিখেছেন । আমি একমত হইনি । প্রতিবাদ করেছি এবং আরও প্রতিবাদ করব । তাঁকে জেলে ঢুকাতে হবে , শাস্তি দিতে হবে এরকমের কুৎসিত চিন্তা ঘুনাক্ষরেও মগজে উদয় হয়নি । মাওলানা সাহেবেরা লঘুগুরু সব ধরনের অপরাধে একই শাস্তি বিধান করে থাকেন আর সেটা হল মৃত্যুদণ্ড । এমন কি ইসলামী শরিয়াতেও ঘোরতর অপরাধীকেও বিচার করে শস্তি দিতে হয় । সুফিকুল শ্রেষ্ঠ হজরত মুনসুর হাল্লাজকেও (র,) বিচার করে কোতল করা হয়েছিল । যে বিচার হয়েছিল , সঠিক হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে কথা থাকতে পারে । কিন্তু বিচার একটা হয়েছিল । মাওলানা সাহেবেরা বিনা বিচারে যখন তখন যাকে তাঁকে শাস্তি দিতে চান , ফাঁসি দিতে চান , এর ভেতর কোন ইসলাম থাকতে পারে আমি এটা আমি বিশ্বাস করি না ।ইসলামী বিধান অনুসারে বিচার করা হলে ইসলামের ধ্বজাধারী অনেক তথাকথিত মোল্লার পাগড়ী এবং মুণ্ডু কনটা অক্ষত থাকার কথা না । আমি সেসব দিকে যাবো না । আমার ধারনা জনগনের একটা অংশের ওপর মাওলানা সাহেবদের যেহেতু প্রভাব আছে সে জন্যই তাঁরা কোন রকম চিন্তা না করেই এই ডণ্ডের কথা উচ্চারণ করেন । যেহেতু তাঁরা জানেন , যা-ই বলবেন একদল মানুষ তাঁদের পেছনে সব সময় জান করবান করার জন্য পাবেন । এটা ইসলামের বিধান নয় । এই ধরনের চিন্তা চেতনার মধ্যে ইসলামী শরিয়াতের চাইতে বেক্তিগত আস্মিতার ভাব প্রবল । এগুলো আসলে আত্নহনন চিন্তারই নামান্তর । এই সমস্ত কর্ম যারা করে তাদেরকে গাল দিয়ে কিংবা নিন্দা করে তাঁদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে একথা ঠিক নয় । খুন করলেও এটা বন্ধ করা যাবে না । যে মনের থেকে এই জাতীয় চিন্তা - চেতনার জন্ম হচ্ছে যে মনটির শুশ্রূষা করে যদি আরোগ্য করা না যায় আমরা কেউ তার হাত থেকে রেহাই পাব না । উৎস বইঃ প্রবন্ধ সমগ্র , তৃতীয় খণ্ড (৭৬-৭৮ পৃষ্ঠা )

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জাতীয়তাবাদ আরেকটি ধর্ম বই

বাংলাদেশীরা ধর্মভীরু। ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও জাতীয়তাবাদ নামক ধর্মগুলোর প্রতি বাঙ্গালীর দুর্বলতা নতুন কিছু নয়। আমরা যারা মুক্ত-চেতনাকে প্রয়োজনীয় মনে করি, যুক্তিকে ধর্মের ওপরে স্থান দেই তাদের অনেকেই ধর্মের মতই সামনে আসা অন্যান্য প্রতিটি ধারনা ও প্রস্তাবনাকেই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাই, খতিয়ে দেখতে চাই। বা দদূএকটি রূপ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম হিসাবে মানুষের দলবদ্ধ সমাজব্যবস্থার দ্বিতীয় বড় চালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রস্তরযুগে আরো একটি ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল। মানুষেরা নিজেদের গ্রাম বা নগরকে কেন্দ্র করে একটি সামষ্টিক পরিচিতি অনুভব করে শুরু করেছিল। বোধ করি তখন থেকেই মানুষের দলবদ্ধতার তৃতীয় চালক জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক যাত্রা শুরু। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদ নানান চেহারায় দলবদ্ধতার সবচাইতে শক্তিশালী চালক হিসাবে বিদ্যমান। একটি নৃগোষ্ঠী যখন পুঁজিবাদী হতে শুরু করে, যখন সে একটি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র গঠন করে তখনই সে একটি জাতিতে পরিণত হয়। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ আমাদের দেশের রাজনীতিতে কাছাকাছি আছে ইতিহাসের শুরু থেকে। মহাভারত থেকে আজকের খালেদা-হাসিনার রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ একে অন্যের হাত...

গাজওয়াতুল হিন্দ

গাজওয়াতুল হিন্দকে বর্তমান বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল শ্রীলংকার জিহাদীরা তাদের মনে আটকে রেখেছে। এই বিষয়ে নানা মতাভেদ থাকলেও সকল মুসলিম জিহাদীরা মনে করে বা আ শা করে যে ইসলাম সারা পৃথীবিতে এই জিহাদের মাধ্যামে প্রতিষ্টা হবে। তারা এটাকে মর্যাদার্পূণ জিহাদ বলে মনে করে। ইসলামের ভিত্তির অন্যতম হলো জিহাদ। ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালীন প্রচুর যুদ্ধ করা এবং হত্যার পরেই মানুষ ভয়ে ইসলামকে গ্রহন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ভায়রাস বলা হয় ইসলামকে। এই ভায়রাস আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে গাজওয়াতুল হিন্দকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে জিহাদীরা তাদের দলে লোক বেসি করার জন্য অনলাইনে সহ নানা জাগাতে ঠিক এই ভাবে মুসলিমদের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে "গাজওয়াতুল হিন্দ বা ভারতবর্ষের যুদ্ধ সম্পর্কে কি আপনি অবগত? আপনি কি কাফের মুশরিকদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত?" ইসলামীষ্ট  জিহাদীরা ঠিক এভাবে চাই যে সারা পৃথিবীতে সবচে’ বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটা হবে হিন্দুস্তান তথা ভারতের হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের যা সমস্থ জ্ঞানি ইসলামি স্কলার এবং আলেম উলামা জানে। মুসলমানদের জন্য এটা খুব বড়  জিহাদ এবং এই জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই...

বাঙালি এবং লেখকের জীবন

লেখকের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত তার পরিবারের স্বীকৃতি।এখানে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে-লেখালেখি যে একটি কাজ,অন্য মতোই একটি কাজের, এবং সেই কাজের জন্য মনোযোগ,সময় এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়-এই বোধটা তৈরী হওয়া।লেখালেখিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে নাই বা ধরা হলো। কিন্তু এটি যে একটি কাজ,এই স্বীকৃতিটা পরিবার থেকে আসা খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বান লেখক শেষ পর্যন্ত যে লেখক হয়ে উঠতে পারে না,লেখক জীবন যাপন করতে পারেন না,লেখালেখির জগত থেকে তাদের যে অকাল বিদায় নিতে হয়,তার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।লেখালেখিকে পারিবারিক ভাবে স্বীকৃতি না দেওয়া।দেশের অন্য সব মানুষদের মতোই বেশির ভাগ পরিবারে লেখালেখি একটি নেহাৎ ই শখের জিনিস।তারুণ্য বা অংকুরোদ্গমী যৌবনে যৌনতার চুলকানিরও পেয়ে বসে আমাদের দেশের মানুষদের।তখন তাদের লেখাকে বাবাহা দেয় বাড়ির ভাবীরা,কাকা-জ্যাঠারা,সহপাঠীরা,বা তার কোন প্রেমিক-প্রেমিকাও।কখনো কখনো এমনকি বাবা মাও।তারা সকলেই অবচেতনে,এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে,এই চুলকানি বেশিদিন থাকবে না।কিন্তু যার ক্ষেত্রে থেকে যায়,অর্থাৎ যে বুঝে যায় যে লেখক হওয়াটাই তার ভবিতব্য,সমস্যাটা তার ক্ষ...