এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বিশ্ব হিজাব দিবস

লিখেছেন - সুষুপ্ত পাঠক

                                            প্রতিকী ছবি 



ইসলামে রাষ্ট্র ধারণা তিন প্রকারের। দারুল হার্ব, দারুল ইসলাম ও দারুল আমান। দারুল হার্ব হচ্ছে কাফেরদের দেশকে বুঝায়। দারুল ইসলাম হচ্ছে যেখানে মুসলমানরা শাসন ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় এবং কুরআনের শাসন কায়েম করে ফেলে। দারুল আমান হচ্ছে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও সমান ধর্মীয় অধিকার ভোগ করে, অমুসলিম রাজা বাদশাহ হলেও যেখানে মুসলমানরা তাদের ধর্ম প্রচার করতে পারে এবং সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে। হযরত মুহাম্মদ দারুল হার্ব থেকে মুসলমানদের হিযরত করতে বলেছিলো। এ কারণে ইসলাম মতে কাফেরদের দেশে মুসলমানরা বাসবাস করতে যাবে না। সেক্ষেত্রে দারুল ইসলাম না হলেও দারুল আমানকে তাদের বেছে নিতে হবে।
ইংরেজ শাসিত ভারতকে মুসলিম নেতাদের বেশির ভাগ ‘দারুল আমান’ মনে করত। অল্প সংখ্যক ভারতকে দারুল হার্ব মনে করত। এরা ঈদের নামাজ তাই প্রত্যাখান করেছিলো। দারুল হার্বে ঈদের নামাজ পড়া হারাম। হযরত মুহাম্মদের সময় আবিসিনিয়ার বাদশা ছিলেন খ্রিস্টান। আবিসিনিয়াতে খ্রিস্টান ইহুদী কোন ধর্ম মতেই চালিত হত না। এখানে খ্রিস্টান ইহুদী এমনকি সদ্য ইসলাম নামের একটি ধর্মের যারা অনুসারী ছিলো তাদেরও কোন ধর্মীয় বাধা ছিলো না। স্বাধীনভাবে সবাই তাদের ধর্ম পালন ও প্রচার করতে পারত। মুহাম্মদ তাই তার সাহাবীদের আবিসিনিয়াতে গিয়ে অভিবাসী হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবিসিনিয়া যে সেকালের সেক্যুলার ছিলো সেটি স্পষ্ট। অর্থ্যাৎ দারুল আমান হচ্ছে সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থা। দারুল আমানে ঈদের নামাজ পড়া জায়েজ। দারুল হার্বে ঈদের নামাজ পড়া হারাম। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা জেমবি’র মত ইসলামিক জঙ্গি দলগুলো মনে করে বাংলাদেশ আসলে দারুল হার্ব কারণ এখানে কাফের বেদ্বিনদের বানানো আইনে পরিচালিত হয়। এ কারণে তারা শোলাকিয়া ঈদের নামাজে বাধা দিয়েছিলো বা ভীতি সৃষ্টি করে মুসল্লিদের কাছে দারুল হার্বের ফতোয়াকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলো। যাই হোক, সেক্যুলার আবিসিনিয়াকে মুহাম্মদ তার ইসলামী খিলাফতের অধিনে নিয়ে এসেছিলেন পরের ১৩ বছরের মধ্যে। আবিসিনিয়া পরিণত হয়েছিলো দারুল ইসলামে। যে আবিসিনিয়াতে অভিবাসী মুসলমানরা তাদের নতুন ধর্ম প্রচারের সুবিধা পেয়েছিলো, সমান নাগরিক অধিকার লাভ করেছিলো সেখানেই যখন তারা ইসলামী খিলাফত করল তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় কেবল মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো। অমুসলিমদের উপর জিজিয়া কর চাপল। তারা হলো দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। মুসলিমদের ধর্মীয় আইন প্রয়োগ হলো শাসন ব্যবস্থায়। ইসলাম অমুসলিমদের যে সীমাবদ্ধ অধিকারকে স্বীকার করে সেটাই মুখ বুজে মানতে বাধ্য হলো খ্রিস্টান ও ইহুদীরা। অথচ একদা সেক্যুলারিজমের সমস্ত সুবিধান নিয়ে মক্কায় টিকতে না পারা মুসলিমদের মুহাম্মদ আবিসিনিয়াতে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ সেক্যুলার শাসন ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে এটাই প্রমাণিত করেছে যে, সেক্যুলার শাসন বা রাষ্ট্র সর্বউৎকৃষ্ট। আবিসিনিয়ার বাদশা যদি ইসলামিক খিলাফতের মতই কোন শাসন ব্যবস্থা চালাতো তাহলে সেখানে কোন মুসলমান তার ধর্ম প্রচার করতে পারত না। মুহাম্মদও তার সাহাবীদের সেখানে যেতে বলতেন না।
বর্তমান আলেমদের মত হচ্ছে, ইউরোপ আমেরিকা দারুল আমানের পর্যায়ে পড়ে। কারণ এসব দেশে ইসলামিক আইন প্রয়োগ করার অধিকার মুসলমানদের নেই কিন্তু সেখানে তারা স্বাধীন এবং তাদের ধর্ম পালনের কোন বাধা নেই। সেখানে তারা মসজিদ বানিয়ে আজান দিতে পারে, তাদের ধর্মীয় সমস্ত বিধান পালন করে এবং সরকার থেকে তাদের প্রশ্রয়ও দেয়া হয়। তবে সশস্ত্র জিহাদী দলের বেশির ভাগই ইউরোপ আমেরিকা সহ সমস্ত অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকেই দারুল হার্ব মনে করে। এখানে থাকা মুসলিমদের তাই হিযরত করে অন্যত্র চলে যাওয়া উচিত বলে তারা বিশ্বাস করে। একই সঙ্গে এইসব দারুল হার্বে ইসলামের খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের চেষ্টা চালানো ফরজ বলে তারা মনে করে। যাই হোক, দারুল আমানকে দারুল ইসলাম বানানোর পরিকল্পনা কিন্তু কোন পক্ষই অস্বীকার করে না। শান্তিপূর্ণ খিলাফতবাদীদের মত হচ্ছে, দারুল আমানে সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কাফেরদের গণতান্ত্রিক ফর্মূলা অনুযায়ীই নিজেদের ধ্যান ধারণা রাষ্টে চাপানোর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই রাষ্ট্র চিন্তা পৃথিবীর সাড়ে চার হাজার ধর্মের আর একটিতেও নেই। হযরত মুহাম্মদ নবী এবং সম্রাট ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধ ক্রুসেড যীশু বা তার সাহাবীদের কোন নজির থেকে সূচনা হয়নি। যীশুর একটিও বাণী পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি পৃথিবীব্যাপী খিলাফত কায়েম করতে বলছেন। হিন্দুদের ‘রামরাজ্য’ শব্দটিও বানানো যার ধর্মীয় ভিত্তি নেই। তাছাড়া রাম উত্তর ভারত ছাড়া অন্য কোথাও প্রধান দেবতা হিসেবে মান্য হন না। অপরদিকে তামিলরা রাবনকে দেবতা হিসেবে পুজা করে থাকে। তাই খিলাফত ইসলামের একান্তই নিজস্ব বিষয়। পৃথিবীর একমাত্র রাজনৈতিক ধর্ম যা সরাসরি ধর্ম প্রবর্তকের কাছ থেকে এসেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মের এই রাজনৈতিক লক্ষ্য কতজন মুসলিম প্যাক্টিস করেন? ঢালাওভাবে সব মুসলমানকে খিলাফতবাদী বলাটা যুক্তিযুক্ত হবে না মনে হয়। তবে গোটা বিশ্বে যদি হাজার খানেকও এই খিলাফতবাদী থেকে থাকে তাহলেও বিপদটা বেশ বড়। কারণ স্বয়ং প্রফেট মুহাম্মদের সোর্স থেকে খিলাফতের নির্দেশ এসেছে। এই যে কিছুদিন আগে ‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ পালিত হলো, সেটিকে কোন মতে নিরহ কোন আন্দোলন হিসেবে দেখলে আপনি ভুল করবেন। এই আন্দোলনের পিছনে যারা আছেন তারা দারুল আমানকে কাজে লাগিয়ে দারুল ইসলাম করার বাসনা থেকে কাজ করছে। যদি আপনি মনে করেন এসব অসম্ভব চিন্তা যে আমেরিকাকে দারুল ইসলাম করা আদৌ সম্ভব, কিন্তু যেটি আপনাকে মাথায় রাখতে হবে আপনার প্রতিবেশী আপনাকে নিয়ে, আপনার সমাজ নিয়ে কেমন আশাবাদ পোষন করেন। ইউরোপের রাস্তায় গাড়ি উঠিয়ে যে জিহাদীরা মানুষ হত্যা করে তারা সংখ্যায় নগন্য হলেও এরকম ধার্মীক কয়েকজনই যথেষ্ঠ গোটা কমিউনিটিকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য। যেমন হিজাব দিবসের কথাই আবার বলি, ইসলামের নারীর পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক। কোন নারী এটি করতে না চাইলে ইসলাম তার উপর জোর প্রয়োগ করতে বলেছে। সেই বল প্রয়োগ করবেন বাবা ভাই কিংবা স্বামী। এরকম একটি আইনকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে বলা হচ্ছে হিজাব হচ্ছে মুসলিম নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার। একজন মানুষের পোশাক পছন্দ করার যে ব্যক্তি স্বাধীনতা হিজাব হচ্ছে মুসলিম নারীদের সেই অধিকার। অমুসলিম সেক্যুলাররা এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে। তারাও বলছে মুসলিম নারীদের এই অধিকার নিয়ে যারা টিজিং করবে তাদের দমন করতে হবে ইত্যাদি। অথচ হিজাব বোরখা তথা পর্দা মান্য না করলে মুসলিম নারীদের শাস্তি দেয়ার কথা ইসলামী আইনে আছে। পশ্চিমের মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে দারুল ইসলাম দীর্ঘ সময় নিয়ে বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়মিত মসজিদ বা ইসলামিক সেন্টার থেকে চর্চা করা হয়। মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ তাদের সেই দেশকে তারা ‘মুসলিম দেশ’ বানায়নি তেমন কোন নজির নেই। কাজেই আপনি যতই দাবী করুন সাধারণ মুসলমান এইসব জানে না বা বিশ্বাস করেন না- সেটি আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না।
প্রশ্ন হচ্ছে এর সমাধান কি? সমাধান সেক্যুলারদের কাছেই। ধর্মীয় অধিকারকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার তাতে কোন সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে রোজা রাখতে গিয়ে একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে গেলে তার রোজা ভঙ্গ করার বিধান ধর্মে আছে। তেমনি হিজাব বা পর্দা ধর্মের নির্দেশ হলেও যেখানে নিরাপত্তার প্রশ্ন সেখানে এই হিজাব বা পর্দা শিথিল হতে বাধ্য। যেখানে ড্রেসকোড নির্দিষ্ট সেখানেও এই পর্দা শিথিল বা পরিত্যাক্ত হতে হবে। একইভাবে নাজমা বেগমদের হিজাব দিবসকে সেক্যুলাররা উৎসাহিত করার মত ইরানী নারীদের হিজাব প্রত্যাখ্যান আন্দোলনকেও তাদের দুহাত তুলে সমর্থন করার অভ্যাস করতে হবে। চিনতে হবে কোনটি অধিকার আর কোনটি গোপন অভিসন্ধি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ