এই ব্লগটি সন্ধান করুন

ধর্ম একটি সামাজিক ব্যাধি



মানবজাতির মধ্যে এমন খুব কমই আছে, ‘ক্যান্সার’ শব্দটি শুনলে যার বুক কেঁপে ওঠেনা। ক্যান্সার বা কর্কটরোগ হল মৃত্যুর পরোয়ানা। একবার ক্যান্সার ধরলে পরে তার থেকে বেঁচে ফিরে আসাটা প্রায় দুষ্কর, চিকিৎসা সব সময়ে সম্ভব হয় না, আর হলেও যে সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটবেই এরকম কোন গ্যারান্টী নেই। কিন্তু কি এই ক্যান্সার? কেন সে এত বিধ্বংসী? ক্যান্সার কোন এক অসুখ নয়। এটি বেশ কিছু ধরণের অসুখের একটি সমষ্টি বিশেষ, যার সকলের মধ্যে অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হল কতিপয় কোষের অনিয়ন্ত্রিত বন্ধনহীন বৃদ্ধি এবং বিভাজন। এই নিয়ন্ত্রণহীনতার ফলে অচিরেই কোষসমূহ তাদের আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সুস্থ কোষকলা বা টিস্যুকে ধ্বংস করে। ধ্বংসাবশেষে যখন আর কিছু থাকেনা, তখন ক্যান্সারগ্রস্ত কোষগুলো রক্ত বা লসিকা মারফত বাহিত হয়ে শরীরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে – যাকে বলে ‘মেটাস্ট্যাসিস’ – এবং সেখানেও একইভাবে শরীরময় বিধ্বংসী কাজকর্মে ব্যাপৃত হয়। কোন কোন কোষ কেন ক্যান্সারগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তার সাধারণত দুটি কারণ মনে করা হয়। এক, পরিবেশগত, পরিবেশ থেকে আহৃত বিভিন্ন সিগ্‌ন্যাল কিছু কোষ-এর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। দুই, জিনগত, কিছু জেনেটিক অ্যাবনর্মালিটি থাকলে পড়ে ক্যান্সার হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এই জিনগত বিকৃতি অনেক সময়ে বংশপরম্পরায় চলে আসতে পারে।
ক্যান্সারের কথা সকলেই জানে এবং তার ফলাফল সম্পর্কে অবহিত। তাই আমার এই পোস্ট, শারীরিক ক্যান্সার নিয়ে নয়। মানবিকতা, সুস্থ মানসিকতা, জনজীবনের ওপরেও ঠিক একই রকম ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে এক সামাজিক ক্যান্সার – তার নাম ধর্ম, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। এর প্রভাব এবং ফলাফল সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত কম লোকে জানে, এবং অনেকে জানলেও মেনে নিতে অস্বীকার করে। অনেকে আবার মনে করে, চোখ শক্ত করে বন্ধ করে, দুই হাতে কান চেপে বন্ধ করে, মুখে চিৎকার করে ‘লালালালালালালা’ আওয়াজ করলেই এর কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয়, সেভাবে কিছু হয় না। ধর্মের কুপ্রভাবকে লড়ে আটকানোর একমাত্র পন্থা হল জ্ঞান, বা নলেজ, এবং সম্যক অবগতি, বা অ্যাওয়্যারনেস।
অনেক ধার্মিক মধ্যপন্থী (রিলিজিয়াস মডারেট)-র বক্তব্য হল, ধর্ম তাদের একান্ত নিজস্ব জিনিস। তাদের অনুভূতির, তাদের চিন্তন-মনন-এর উপর ন্যস্ত তাদের ধর্মভাব। তারা কারও ক্ষতি জানতে করছে না, শুধু নিজেদের মত করে নিজের ঈশ্বর-এর আরাধনা করতে চায় – তাতে কারর কিই বা বলার থাকতে পারে? তারা এও বলে থাকে, যে ধর্মের নামে যারা অন্যের ক্ষতি করে, মারামারি কাটাকাটি করে, তারা সঠিকভাবে ‘ধর্ম’-এর অর্থ বোঝেনি, ইত্যাদি। অর্থাৎ কিনা, তাদের বোঝা যে ধর্মের রূপ, তাদের মাথায় রাখা যে ধর্মের ছবি, সেটাই আদতে ধর্ম নামে পরিচিত হবার যোগ্য; বাকি অন্যান্যরা বিপরীত কথা যা বলে সব ভুল। যুক্তিশাস্ত্রে এর নাম হলো, ‘নো ট্রু স্কটসম্যান‘ ফ্যালাসি বা অ/কুযুক্তি। মুশকিল হল, যেহেতু ঈশ্বর (ভগবান, গড, আল্লাহ, আহুরা মাজদা, গাইয়া, য়াহওয়ে, জিউস – বা অন্যান্য যে নামেই ডাকা হোক না কেন) নিজে নেমে এসে কখনোই বুঝিয়ে দিচ্ছে না, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তাই মধ্যপন্থীদের অপেক্ষাকৃত উদার ধর্মচেতনা আর মৌলবাদীদের অতিরক্ষণশীল, অনুদার, অসহিষ্ণু ধর্মব্যাখ্যা – দুটোর কোনটা একে অপরের থেকে বেশী গ্রহণযোগ্য, সেটা নির্ণয় করা নিতান্তই দুরূহ। কিন্তু কুপ্রভাব বা ফলাফলের দিক থেকে দুটোই সমান – দু’দিকেরই আসল উদ্দেশ্য হল মানুষের জীবনযাপনের উপর সর্বময় কর্তৃত্ববিস্তার।

কেন ধর্ম ক্যান্সার-গোত্রীয়? প্রথমত, পরিবেশের প্রভাব। কোন শিশু কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্মায় না। জন্মানোর পর থেকেই একটু একটু করে কাজে কর্মে, কথায় বার্তায়, আকারে ইঙ্গিতে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কোন একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি আনুগত্য। এই আনুগত্য বহুসময়েই আসে চরম মূল্যে – সুকুমার বৃত্তিগুলোর অবদমন এবং অচিরেই বিনাশ; পরসহিষ্ণুতা, জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা এবং প্রচেষ্টা, এবং সুস্থ ব্যালান্স্‌ড মানসিকতার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি।

দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এবং প্রসার। ধর্ম (প্রকারান্তরে ধর্মীয় আবেগ বা ধর্মীয় অনুভূতি) কখনও আত্মনিমগ্ন থাকে না, সেরকমটা তার প্রকৃতির বহির্ভূত। কোন মানুষের ধর্মচেতনা কিছুতেই সেই মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়না। ধর্মভাব মাথায় জাগলে সেটা অচিরেই চায় ছড়িয়ে পড়তে, এক মাথা থেকে অন্য মাথায়, একের চিন্তা থেকে অন্যের চিন্তায়; সমমনস্ক মানুষের আবেগ অনুভূতির মধ্যে সূক্ষ্মভাবে প্রবিষ্ট হয়ে স্বল্পসময়ের মধ্যে দখল করে নিতে তার মস্তিষ্কের সমস্ত উচ্চতর কার্যাবলী (হাইয়ার নিউরাল ফাংশান্‌স) – বুদ্ধি, যুক্তি, বিবেচনা, সুস্থচিন্তা, নৈতিকতা সমস্তই তখন ছিটকে যায়, রয়ে যায় শুধু উন্মাদনা।

সেটা কি ধরণের উন্মাদনা? সবচেয়ে বিষাক্ত, ক্ষতিকারক এবং ছোঁয়াচে ধরণের। যে উন্মাদনা কোন যুক্তি মানেনা, সাধারণ বুদ্ধি মানেনা; যে উন্মাদনা নির্ভরশীল একটি অদৃশ্য, অলীক, অনুপস্থিত, কল্পনাপ্রসূত ব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ বা এনটিটি-র উপরে; যে উন্মাদনার দৃঢ় ধারণা যে সেই এনটিটি মানুষের কথা চিন্তা করে সমস্ত সৃষ্টির ইতিকথা লিখে গেছে কয়েকশ পাতার ধর্মপুস্তকের মধ্যে – এবং সেই অযাচিত ঐশী বাক্যসমূহ অক্ষরে অক্ষরে সত্য যদিও তাদের উৎস বা প্রোভেনেন্স পরীক্ষা করতে গেলে অনেক রকম গন্ডগোল ধরা পড়ে; যদিও অনেক সময়ই প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মপুস্তকটি অনুবাদের সংস্করণ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম কথা বলে থাকে।

এ হোল সেই উন্মাদনা, যার বশবর্তী হয়ে একদল মানুষ নিশ্চিন্তে, নিশ্চুপে তাদের জীবনের সম্পূর্ণ দখল বা কন্ট্রোল তুলে দেয় এক বা একাধিক অন্য মানুষের হাতে, যারা নিজেদের ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। এবং সেই সব ধর্মীয় নেতার অঙ্গুলিহেলনে বা মুখের একটা কথায় তারা মানবত্বকে শিকেয় তুলে, যুক্তি-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে নেমে পড়ে ঘৃণ্য, জঘন্য, হীন, পাশবিক আচরণ করতে। আর সেই সব আচরণে যোগদান করাটা খুবই সহজ, কারণ ধর্মের ছায়া থাকতে কাউকে তো নিজের কোন কাজের দায়িত্ব বা রেসপন্সিবিলিটি বহন করতে হয়না। ওই যে, আইনে একটা সুন্দর অজুহাত আছে – স্বল্পসাময়িক উন্মত্ততা, টেম্পোরারি ইনস্যানিটি; ধর্মের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী।

ধর্ম হল সেই উন্মাদনা যাকে যেন-তেন-প্রকারেণ প্রতিষ্ঠিত করতেই হয় যে সেই শ্রেষ্ঠ, সে-ই শেষ কথা। তাই বিভিন্ন মানুষের যদি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মানুভূতি থেকে থাকে, ধর্মের ক্রিয়াকলাপ, আচার-ব্যবহার যদি আলাদা হয়ে থাকে, ধর্মের বাণী সম্পর্কে মতামত ভিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে যেভাবেই হোক এক পথে নিয়ে আসতে হবে, এক মতে নিয়ে আসতে হবে। যে কোন মূল্যে। অবশ্য ধার্মিক লোকজনের কাছে সাধারণভাবে নিজের ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুর মূল্য নেই। নেই জীবনের মূল্য, নেই সভ্যতার মূল্য, নেই মানুষের মূল্য। আছে শুধু এক সর্ব আগ্রাসী উন্মাদনা। ভেবে দেখলেই পরিষ্কার হয়, যে এই উন্মাদনার উৎপত্তি বেশ সুপরিকল্পিত – কারণ উন্মাদনা থিতিয়ে পড়লেই মানুষ তখন চিন্তা করতে চায়, আর চিন্তা করলেই তো ধর্মের অসারত্ব ধরা পড়ে যাবে। তাই যুগে যুগে ধর্মীয় নেতারা এই উন্মাদনাকে জিইয়ে রাখবার আয়োজন করে এসেছে।

এবং সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, সেটা হল ধর্মের এহেন প্রসার থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মুশকিল হল এই যে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনাকে বজায় রাখানোর জন্য কোন প্রতিষেধক বা ভ্যাক্‌সিন নেই। আমাদের ধর্ম-ভিত্তিক, বা আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা দিতে গেলে, ধর্মের-আতিশয্য-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় শৈশবাবস্থা থেকেই পদে পদে বোঝানো হয় যে ঈশ্বরের ধারণাটা অলীক কল্পনা নয়, ধর্ম একটি উপকারী এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এই মিথ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব সহজ হয়না অনেকের পক্ষেই। এবং সেভাবেই এক মানুষের থেকে অন্য মানুষে, এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশন-এ ধর্ম সংক্রামিত হয়।

ক্যান্সারের মতনই, ধর্ম সভ্যতার বিনাশকারী। সেই কারণেই স্বনামধন্য সাংবাদিক, লেখক ও নাস্তিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স বলছেন, “রিলিজিয়ন পয়জন্‌স্‌ এভরিথিং” (ধর্মের বিষাক্ত স্পর্শ সব কিছুকে বিনষ্ট করে); আমার কথা না যাচাই করে শোনার বা আমল দেওয়ার প্রয়োজন এক্কেবারেই নেই। চোখ তুলে তাকিয়ে সমসাময়িক পৃথিবীর দিকে দেখলেই প্রতীতি জন্মাবে। মানবতার পরিপন্থী যত ঘটনাসমূহ ঘটেছে – বেশীদূরে যাবার দরকার নেই, বিগত দশ বছর বা দুই দশকের দিকে দেখলেই হবে – তার প্রায় প্রত্যেকটির কোন না কোন ধর্মীয় অংশ বা কম্পোনেন্ট রয়েছে, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে। ধর্মের ছোঁয়া লেগে যেই মূহুর্তে সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তি এবং যৌক্তিকতার বিনাশ ঘটে, সেখানেই যে মানবতার পতন ঘটবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?

এই লেখাটার পরিপ্রেক্ষিতে আজ বড় বেশী করে মনে পড়ছে জন লেননের লেখা ইম্যাজিন গানটির অসাধারণ লাইনগুলো। খুবই ইচ্ছে হওয়ায় নিজের মত করে অনুবাদ করলাম গানটির। মানগত ফারাকের জন্য অবশ্যই লেনন-এর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

ভেবে দেখো, স্বর্গটা নেই
- সহজ কথা সহজ করে -
নরক নিচে নেইকো মোদের
শুধুই আকাশ মাথার ‘পরে
ভেবে দেখো, মানুষ যত
বাঁচছে, আজ-কে বাঁচার তরে।
ভেবে দেখা নয়তো কঠিন -
দেশ বিদেশের নেই সীমানা
মারা-মরার নেই তো কারণ
ধর্মেরও আজ নেই জমানা
শান্তিতে তাই বাঁচছে মানুষ
আজ কোন আর নেই যে মানা।
বলতে পার, স্বপ্ন দেখছি।
নই তো আমি একলা সে জন
হয়ত তুমিও জুড়লে এসে -
ধরার সেদিন এক প্রাণ মন।
মনে কর, পারবে যদি,
জমায় না কেউ বিষয়-আশয়
লোভ বা ক্ষুধার নেই প্রয়োজন
ভাইচারাতেই মানুষ যে হয়।
ধরার মাটির সমাংশ ভাগ -
মানুষ-মানুষ সুখেই রয়।
বলতে পার, স্বপ্ন দেখছি।
নই তো আমি একলা সে জন
হয়ত তুমিও জুড়লে এসে -
ধরার সেদিন এক প্রাণ মন।




মস্তিষ্কের উপরে ধর্মের প্রভাব 


সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান পত্রিকায় বেশ কিছুকাল আগে প্রকাশিত
http://www.scientificamerican.com/article.cfm?id=religious-experiences-shrink-part-of-brain
 একটি লেখার সূত্রে এই পোস্টের অবতারণা। এই লেখাটা শুরু করার আগেই একজন বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে একটা কথা সবাইকে মনে করিয়ে দি – কোরিলেশন ডাজ নট ইক্যুয়েট অর সিগনিফাই কজেশন, অর্থাৎ দুটি ঘটনার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে বা সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকলেও একে অন্যের কারণ বা নিদান হবেই সে কথা ধ্রুবসত্য নয়। এই ব্যাপারে অবশ্য সংখ্যাতত্ত্ববিদরা অনেক ভাল বোঝাতে পারবেন, কিন্তু এই মৌলিক ধারণাটি আমরা যারা যুক্তিবাদী এবং প্রমাণ-নির্ভর চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা করে থাকি, তাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

আইচ্ছা যাউকগা। আসল গল্পটা আমার এই জ্ঞানদানের থেকে অনেক বেশী উৎসাহবর্দ্ধক। মানুষের মস্তিষ্ক এবং ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে ইদানীং অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে মস্তিষ্কের ওপর বিভিন্ন ধর্মাচরণ সংক্রান্ত কাজ, যেমন ধ্যান এবং প্রার্থনা, তার আপাত ফলাফল বা অ্যাকিউট এফেক্ট নিয়ে, আবার কিছু কাজ হয়েছে ধর্মের দীর্ঘসাময়িক বা ক্রনিক ফলাফল নিয়ে। সাধারণ ভাবে এই কাজগুলো তে যারা ধার্মিক ক্রিয়াকল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাদের মস্তিষ্কের আয়তন বা কার্যকুশলতার তুলনা করা হয়েছে নির্ধার্মিক-দের বা যারা ধার্মিক হলেও ততটা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করেনা তাদের সঙ্গে। আবার কিছু পরীক্ষা হয়েছে একই লোকেদের নিয়ে, দুটো সময়বিন্দুতে – যখন তারা ধর্মের চর্চা করতনা, এবং যখন সেই একই লোক অতোঃপর ধ্যান-প্রার্থনা-ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদিতে সময় দিয়েছে।

অনেক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা, অতি উদ্বেগ বা অ্যাংজায়েটি, মানসিক অবনমন বা দৌর্মনস্য বা ডিপ্রেশন-এর ওপর ধর্মের ফলাফল সুখকর। আবার প্রচুর পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ধর্মের ফলাফল হানিকারক। বিশেষত, যারা ধর্মীয় ভাবে সংখ্যালঘু বা ধর্মের কারণে অত্যাচারিত, তাদের জীবনে অনেক বেশী স্ট্রেস এবং উদ্বেগের উপস্থিতি থাকে। আবার অনেক সময়ে, এই উদ্বেগের কারণ হয় ধর্মবিশ্বাস, যখন লোকে মনে করে বা তাদের বলা হয় যে ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিচ্ছে, অথবা তাদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তাদের ধর্মমতের মিল হচ্ছে না। মূল কথাটি এখানে বলা যেতে পারে, যে যেহেতু ধর্মের পুরোটাই মন গড়া, তাই কার ওপরে তার কিরকম এফেক্ট হবে সেটা অনেকাংশেই তাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার ওপর নির্ভর করে।

আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এমি ওয়েন এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে,,
http://www.plosone.org/article/info:doi%2F10.1371%2Fjournal.pone.0017006
 তাতে একটি আশ্চর্য জিনিষ জানা গেছে। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যেখানের একটি অংশের নাম হল হিপ্পোক্যাম্পাস। এই অংশটি মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের একটা অঙ্গ, এবং এর কাজ হল আবেগ-এর নিয়ন্ত্রণ আর স্মৃতি তৈরী করা। এই গবেষণাতে অংশগ্রহণ করেছে ৫৮-বছর বা ততোধিক বয়েসের মোট ২৬৮ জন মহিলা ও পুরুষ, এবং এতে তুলনা করা হয়েছে নির্ধার্মিক লোকদের সঙ্গে ধর্মপালনকারী মানুষের। ধার্মিক লোকেদের আবার একাংশ হল সেই সব মানুষকে নিয়ে যাদের কোন জীবন-পরিবর্তনকারী ধার্মিক অভিজ্ঞতা (লাইফ চেঞ্জিং রিলিজিয়াস এক্সপীরিয়েন্স) ঘটেছে, বা যারা নিজেদের আত্মশনাক্ত করে বর্ন-এগেইন বা পুনর্জাত খ্রীষ্টান হিসেবে। খ্রীষ্টধর্মে এই পুনর্জন্মের অর্থ হল আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ, যা সেই সব মানুষের হয় যারা জীবনের কোন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছে যীশুকে মুক্তিদাতা হিসেবে মেনে নেয়। উইকিপিডিয়া-তে এর ওপর আর্টিকলটি বেশ জ্ঞানগর্ভ।
এই গবেষণায় ওয়েন-এর দল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এম আর আই ব্যবহার করেন হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন মাপতে। তাতে দেখা গেছে, যে যে সমস্ত লোকেদের কোন জীবন-পরিবর্তনকারী বা লাইফ চেঞ্জিং ধার্মিক অভিজ্ঞতা ঘটেছে, তাদের হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন অনেক গুণে ছোট। শুধু তাই নয়, প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিক-দের মধ্যে যারা পুনর্জাত খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী তাদের হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন সাধারণ খ্রীষ্টানদের থেকে ছোট, এবং এই পরিবর্তন তাদের ঐ অংশের ডান এবং বাঁ দুই ভাগেই দেখা গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে দেখা গেছে যে যারা নির্ধার্মিক, তাদেরও হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন বেশ ছোট। গবেষকদল এই ফলাফলের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যাদের ধার্মিক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, বা যারা কোন অতি-সংকটের পরিস্থিতির মধ্যে ধর্ম খুঁজে পায়, তাদের অনেক বেশী স্ট্রেস থাকে, এবং এটা জানা আছে যে স্ট্রেস-সংক্রান্ত হরমোন, কর্টিসল-এর প্রভাবে সময়কালে হিপ্পোক্যাম্পাস-এর সংকোচন ঘটে থাকে।
কিন্তু এটাও তাহলে হয়ত সত্যি যে এখনকার সমাজে, বিশেষত যেই সব সমাজব্যবস্থায় ধর্মোন্মাদনা বর্তমান, সেই সমাজে যারা নাস্তিক বা নির্ধার্মিক, তারাও অত্যন্ত মানসিক ক্লেশের মধ্যে থাকেন, এবং সেই কারণেই তাদেরও মস্তিষ্কের ওই অংশের সংকোচন ঘটে।
ওয়েন-এর স্টাডিটিতে যে প্রকল্প (হাইপোথিসিস)-টি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, তার ফলাফলকে একটি সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা যেতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তনের হ্রাসপ্রাপ্তির ঘটনা অজানা নয়। সেক্ষেত্রে, এটা হতেই পারে যে নাস্তিক বা নির্ধার্মিকদের ওই আয়তনের পরিমাপ তাদের বয়স-হিসেবে নর্মাল; মনে রাখা দরকার যে ওই স্টাডিতে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ছিল ৫৮ এবং উর্দ্ধে। অল্প বয়সে ধর্মের সঙ্গে পরিচিতি, মনে অল্প অল্প ভক্তিভাব জাগা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ইত্যাদির ফলে প্রভূত আবেগের উদ্রেক হতে পারে – এবং আবেগ-এর সঙ্গে হিপ্পোক্যাম্পাসের যোগাযোগ সুজ্ঞাত। বিশেষত, বিপরীতধর্মী আবেগ সমূহ, ধর্মের বৈপরীত্য সম্পর্কে ধারণা, সিলেক্টিভ মেমোরী এবং কগ্নিটিভ ডিজোনেন্স (বৈপরীত্যের ধারণা কে জ্ঞানতঃ আলাদা করে রাখা) – তার মানসিক চাপ, চারপাশের বিভিন্ন ধ্যানধারণার সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা, ইত্যাদির ফলে হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তনের অতিবৃদ্ধি (হাইপারট্রোফি) ঘটা হয়ত খুবই সম্ভব, যার ফলে ধর্মবিশ্বাসীদের ওই আয়তন বড় হয়। কিন্তু যাদের তথাকথিত ধার্মিক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, বা যারা কোন অতি-সংকটের পরিস্থিতির মধ্যে ধর্ম খুঁজে পায় – একবার ধর্মীয় মৌলবাদ মাথায় ঢুকে গেলে তখন পুরোটাই বিশ্বাসনির্ভর, তখন আর কোন দ্বন্দ্ব নেই, দ্বিধা নেই, এবং সেই কারণেই আর কোন দীর্ঘসাময়িক বা ক্রনিক আবেগে উত্তালতার প্রশ্ন থাকে না – তাই তখন আবার হিপ্পোক্যাম্পাস ছোট হয়ে ধর্মপ্রাপ্তির আগের নর্মাল আয়তনে ফিরে আসে।
আমি জানিনা আমার এই লাইনের চিন্তাটি একটা বিচারযোগ্য হাইপোথিসিস কিনা, কারণ মস্তিষ্ক প্রত্যঙ্গ এবং মনোবিদ্যার কার্যকরী সম্পর্কের বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত। এইখানেই আবার করে সেই শুরুর আপ্তবাক্যটি মনে রাখা দরকার। মস্তিষ্কের গঠন বা কাজের সঙ্গে ধর্মের কার্য-কারণ সম্পর্ক বা কজাল রিলেশনশিপ স্থাপন করা খুবই দুরুহ। এই বর্তমান ফলাফলের আরো অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। যেমন লাইফ চেঞ্জিং ঘটনার থেকে বেশী জরুরী হতে পারে সেই পরিবেশ বা পরিস্থিতি যা থেকে সেই ঘটনার উৎপত্তি ঘটে। আবার, যদিও গবেষকরা মনে করছেন যে স্ট্রেসের কারণে এরকম হয়, বর্তমান স্টাডিতে স্ট্রেসের সঙ্গে সরাসরি কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নি, কারণ শুধুমাত্র আপাতকালীন বা অ্যাকিউট স্ট্রেস-ই মাপা হয়েছে, দীর্ঘসাময়িক স্ট্রেস নয়। কিছু কিছু ধরণের মৃগীরোগী, যাদের হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন ছোট হয়, তারা অতি-ধার্মিক বা হাইপার-রিলিজিয়াস হয়ে পড়ে বিনা স্ট্রেস-এই। আবার এটাও হতে পারে, যে যারা অতি-ধার্মিক তারা সহজেই স্ট্রেস-এ আক্রান্ত হয় জীবনে, যার একটা কারণ হতে পারে যে বেশীরভাগ ধর্মেই পার্সোনাল রেস্পন্সিবিলিটি বা নিজস্ব দায়িত্বের শিক্ষা দেওয়া হয় না – সব ঈশ্বরে-সমাপন বা পরিপূর্ণ-নিবেদন গোত্রীয় বিশ্বাসধর্মী ধারণার ওপরে জোর দেওয়া হয়।
ক্রিয়া-পরিমাপক বা ফাংশনাল এম আর আই-র প্রযুক্তি এখনও শৈশবস্থায় আছে। ধীরে ধীরে আমরা মস্তিষ্কের কাজ এবং তার ওপর ধর্মের প্রভাবের কথা আরও জানতে পারব নিশ্চয়।

লিখেছেনঃকৌশিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ