এই ব্লগটি সন্ধান করুন

মিশেল ফুকো


মিশেল ফুকো (১৯২৬ – ১৯৮৪) ফরাসি দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ। ১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের সবচে সম্মানিত কলেজ ডি ফ্রান্সে ‘হিস্ট্রি অব সিস্টেম অব থট’ এর প্রফেসর নির্বাচিত হওয়ার পূর্বেই ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে বিদ্যাজগতে নিজের আসন পাকা করে নিয়েছিলেন। ফুকো বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন শারিরিক ও মানসিক চিকিৎসা শাস্ত্র, কারাগার পদ্ধতির পর্যালোচনার জন্য বিখ্যাত। যৌনতার ইতিহাসের উপরও তিনি বেশ কিছু প্রভাবশালী লেখা প্রকাশ করেন। ফরাসী কাগজ এবং রিভিউ জার্নালে নিয়মিত লিখতেন। তার জ্ঞান ও লেখার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে অনেক গবেষক ও চিন্তাবিদ বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন।

১৯৫০ সালে ফুকো ফরাসি সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেন।কিন্তু বেশিদিন রাজনীতি করার কোন আগ্রহ পাননি ফুকো। ১৯৫৩ সালেই দল থেকে সরে আসেন। এই সরে আসার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল স্টালিনের অধীনে রাশিয়ায় সংঘটিত কিছু অপকর্ম যা ফুকোর মনে বিশেষ রেখাপাত করে। এরপর ১৯৬৮ সাল থেকে ফুকোর রাজনৈতিক সক্রিয়তা বেড়ে যায়। তিনি কয়েদীদের অধিকার আদায়ের জন্য একটা সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সমকামী ও অন্যান্য প্রান্তীক গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ হয়ে নিয়মিত প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। এই সময়েই তিনি এইডস আক্রান্ত হন এবং ১৯৮৪ সালের জুন মাসে অকালমৃত্যু বরণ করেন। তিনিই প্রথম বিখ্যাত ফরাসী যার এইডস রোগ শণাক্ত করা গেছে। সেই সময়ে এই রোগ সম্পর্কে খুব অল্পই জানা যেত।মৃত্যুর আগে, ফুকো তাঁর অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করে যান।

সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের মধ্যে মিশেল ফুকো অন্যতম। ১৯২৬ সালের ১৫ অক্টোবর ফ্রান্সের পইতিয়েহতে জন্ম ফুকোর। বাবার নাম পল ফুকো যিনি ফ্রান্সের বিশিষ্ট সার্জন ছিলেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষে ফুকো বাবার পেশাকেই বেছে নেবেন। কিন্তু ফুকো হয়ে উঠলেন দর্শন-জগতের বাসিন্দা। খ্যাতিমান ইকোল নর্মাল সুপিরিয়র-এ ১৯৪৬ সালে ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত ফুকোর শিক্ষাজীবন বিশেষ উজ্জ্বল ছিল না। ইকোল নর্মালে পড়ার সময় তিনি এতোটাই বিষন্নতায় ভুগতেন যে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিলেন। তখন তাকে একজন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভবত এসময় থেকেই তিনি মনস্তত্ত্বে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অংশগ্রহণ করতে থাকেন জাক লাকাঁর বিশ্লেষণী মনোবিজ্ঞানের সেমিনারে এবং সেইঁ আঁ হাসপাতালেও আসা যাওয়া করতেন। পড়াশোনা আরম্ভ করেন হাইদেগার, মার্কস, ফ্রয়েড, বিশেষভাবে নীৎসের রচনাবলীর।

এখানে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দর্শনের প্রভাষকের পদে চাকরি করেন। ১৯৫৪ সালে তার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। ফুকো তখন বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, শিক্ষকতা তার দ্বারা হবেনা। এই চিন্তা থেকেই ফ্রান্স থেকে দীর্ঘকালের জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। ১৯৫৪ সালে তিনি সুইডেনের উপশালা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রান্সের একজন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার জন্য এই কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তার অন্যতম বন্ধু ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক Georges Dumézil। ১৯৫৮ সালে উপশালা ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য তিনি পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন।

১৯৬০ সালে তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল ডক্টরেট সম্পন্ন করা। এখানকার Clermont-Ferrand-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের একটি পদে চাকরি নেন। এই শিক্ষায়তনেই তার সাথে Daniel Defert-এর পরিচয় হয় যার সাথে তিনি জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন।
ফুকোর সহধর্মিনী কাজের সুবাদে তিউনিসিয়ায় বদলি হয়ে যাওয়ায় ফুকোও সেখানে চলে যান। ১৯৬৫ সালে তিউনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

দার্শনিক ধারার সাথে ফুকোর সম্পৃক্ততা বিচার করলে বলা চলে তিনি কান্টের ক্রিটিক্যাল ধারার অনুসারী। তার প্রকল্পকে বলা যায় ‘ক্রিটিক্যাল হিস্ট্রি অব থট’। মিশেল ফুকোকে অনেকেই বলে থাকেন ‘ধোঁয়াটে তাত্ত্বিক’, কেউবা তাঁকে মনে করেন ‘জটিল ও দুর্বোধ্য’, কারো কাছে তিনি ‘তত্ত্বজ্ঞানী’ কিংবা ‘ফুকোশীয় চিন্তার জনক’।

সাম্প্রতিককালের জ্ঞানচর্চায় মিশেল ফুকো এক অনন্য প্রভাবক ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমের জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার পরম্পরার বাইরে গিয়ে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এর অতীত ও বর্তমান, অন্তঃসার ও মেকির পরিমাণ। পাগলামি সম্পর্কিত ধারণা, বিজ্ঞান, ভাষা বিষয়ক উপলব্ধি, যৌনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, আইন ও শাস্তি এসব কিছুর প্রতি আমাদের মনোভাবের গোড়া নড়বড়ে করে দিয়ে গেছে তাঁর রচনাবলী। মুখ্যত ক্ষমতাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তার চিন্তাভাবনা। ক্ষমতা কী? তার প্রকাশ কোথায়, কীভাবে? এই সব প্রশ্নের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বোধবুদ্ধি দিয়ে তিনি মানবসভ্যতার পুনর্বিচার করেছেন। তিনি দেখেছেন প্রচলিত চিন্তাভাবনার প্রায় বিপরীতে দাঁড়িয়ে এবং এভাবেই চিহ্নিত করেছেন আমাদের জ্ঞানচর্চার ফাঁক-ফোকর।

মিশেল ফুকো’র পাগলবন্দনা

কে পাগল? কারা পাগল? কেন এবং কোন স্বার্থে সভ্যসমাজ কাদের পাগল বলে? এর সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্কই-বা কতটুকু? এই বিষয়গুলির উত্তর খুঁজেছেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো। বিষয়টিকে একটু সহজ করার জন্য কয়েকটি দৃশ্যের অবতারণার মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি:

১। বঙ্গপুরে বাস করে ফটিক। সে সবকিছুতেই প্রশ্ন খোঁজে। সভ্যমানুষ থেকে একটু আলাদাভাবে সবকিছু চিন্তা করে। একদিন বঙ্গরাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, রঙ্গরাজকে এক নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করবেন। তাই ঢোল পিটিয়ে প্রজাদের জানানো হল। কিন্তু ফটিকের মনে প্রশ্ন জাগল, ‘কেন বঙ্গরাজা রঙ্গরাজাকে ভোজের নিমন্ত্রণ জানাবে?’ যেখানে প্রজারা অনাহারে মরে, সেখানে রাজ্যের এতোগুলো অর্থ কেন খরচ করবে? তাই ফটিক প্রজাদের সচেতন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বঙ্গরাজা মুশকিলে পরে। তাই সমাধানের জন্য ফটিককে বিচারে ডাকা হল। বিচারে রায় হল, ‘ফটিক একটা উন্মাদ মানুষ’। সে পাগল হয়ে গেছে। তার নাম রাখা হল- ফটিক পাগলা। তার স্থান হল পাগলাগারদে।

২। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে এক কন্যা-শিশুর জন্ম হল। শিশুটি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা, ধর্মান্ধতা, অধিকার, নিয়মতান্ত্রিকতা, যৌনতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হল। কেন এমন হল নারীদের জীবন? পুরুষের মত নারীরা কেন এত সুযোগ সুবিধা পেল না? প্রাপ্তবয়সে তার মনের মধ্যে এক ‘অন্যরকম অবস্থার’ সৃষ্টি হল। একটা সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো সে। বাবা-মা ও আত্মীয়রা মেয়েটির এই পরিস্থিতি সমাধানের উপায় হিসেবে তাকে বিয়ে দিল। বিয়ের পর স্বামী বিষয়গুলো মেনে নিতে পারল না। স্বামীর অভিযোগ তার স্ত্রী একজন মানসিক রোগী। স্বামীর অভিযোগে অভিযুক্ত মেয়েটিকে অবশেষে যেতে হল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। অবশেষে সেই মেয়েটিকে হারাতে হল সামাজিক মর্যাদা, বঞ্চিত হতে হল পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে, এমনকি পরিত্যক্ত হলেন ঘর সংসার থেকে।

৩। বিদ্যালয়ের একজন বাংলা শিক্ষক। তিনি জ্ঞানচর্চায় অনেক বেশি আবেগী। তার এই আবেগটা এমন এক পর্যায়ে ঠেকেছে যা তাঁর মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে। ফলে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। শ্রেণিকক্ষে সুযোগ পেলে কিংবা অতিরিক্ত সময় পেলে শিক্ষার্থীদের সাথে ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক জ্ঞাত হয়ে ওই শিক্ষককে পাঠদানে মনোযোগী হতে বললে তাঁকেও (প্রধান শিক্ষক) ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। একটা পর্যায়ে ওই শিক্ষক সবার মাথাব্যথার কারণ হলেন। আখ্যায়িত হলেন উন্মাদ শিক্ষক হিসেবে। সুতরাং তার চিকিৎসা প্রয়োজন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠালেন।

পাগলামি সম্পর্কে সক্রেটিস যে ধারণা দিয়েছেন তা থেকে আমরা তৎকালীন গ্রীকদের পাগলামি সম্পর্কে মনোভাব জানতে পারি। সক্রেটিস পাগলদের ২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথমটি সম্পূর্ণভাবে জৈবগত সমস্যা আর দ্বিতীয়টি মূলত সামাজিক রীতিনীতি বিবর্জিত আচরণের পর্যায়ভুক্ত। সক্রেটিস দ্বিতীয় ভাগটিতে শিল্পী, প্রেমিক, ধর্মান্ধ, ভাববাদী অথবা নবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে প্লেটো বললেন,দ্বিতীয় ভাগটির উন্মাদনা যতক্ষণ পর্যন্ত না ধ্বংসাত্মক হিসেবে বিবেচিত হয়, তার আগপর্যন্ত এটি বরং সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতেই সাহায্য করে। অর্থাৎ মানব সভ্যতা বিকাশে এই পাগলদের ভূমিকাই মূখ্য।

গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটস পাগলদের নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন বিয়ে হচ্ছে এই রোগ আরোগ্য লাভের সবচাইতে ভালো পদ্ধতি। অর্থাৎ আশ্রম নয় বরং বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধন স্থাপনের মাধ্যমে এদের পাগলামি দূর করা সম্ভব। মধ্যযুগেও পশ্চিমের অনেক দেশে পাগলামিকে পবিত্র বলে গণ্য করা হতো। এখনো কোন পাগল জিকির করলে আমরা তাকে পাগলা পীর হিসেবে মান্য করি।অর্থাৎ মধ্য যুগে পাগলকে সমাজ থেকে বিতাড়িত ঘোষণা করা হয়নি। কিন্ত ফুকো দেখান যে, ইউরোপে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পাগলা-গারদগুলোতে নির্যাতনমূলক চিকিৎসা পদ্ধতির অস্তিত্ব ছিলো আর ঐযুগে কোন কোন অঞ্চলে মানসিক ব্যাধিকে পাপের সাথে সম্পর্কিত বলেও মনে করা হতো”। এই অন্ধকার যুগে ডাইনী/ যাদুকরদের যখন হত্যা শুরু হয়েছিলো, তখন এদের একপ্রকার পাগল হিসেবেই ভাবা হতো।

১৬০৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন প্রথম কিং জেমস। তিনি অশুভ শক্তির ভয় করতেন এবং একারণে তিনি বাইবেলের কিছু লাইনও নিজের মনমতো মত বদলে ফেলেন। তিনি Witch craft act প্রণয়ন করে, এই আইনে ডাইনী আর ম্যাজিশিয়ানদের ফাঁসি দেয়ার কথা বলা হলেও তাদের অনেককে অগুনে পুড়িয়ে মারার নজির পাওয়া যায়। অনেক মানুষকে নিতান্ত তাদের অস্বাভাবিক আচরণের জন্য জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। এসময় ফ্রান্সকে ইংল্যান্ডের হাত থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন জোয়ান অব আর্ক নামক এক বীরকন্যা। তাকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। আসলে এই সময় থেকেই পাগলদের পুরোদমে সমাজ থেকে আলাদা করার একটা প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। এসময় থেকে একসাথে অনেকগুলো উন্মদনাগার প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয় ।

সতেরো শতকে এসে অনেকেই বলতে শুরু করেন উন্মাদনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শারীরিক চিকিৎসাই পাগলামির ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। ফলে পাগলদের ঠিক করার জন্য যথারীতি ডাক্তারও নিয়োগ হল। ফুকো ডাক্তারদের এসকল চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বরং আরো বেশি নির্মম হিসেবে উল্লেখ করলেন। যেমন বরফ ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো, স্ট্রেইট জ্যাকেট ব্যাবহার। ফুকোর ভাষ্যমতে, এ সকল নৃশংস বিচার ও শাস্তি অনবরত চলত যতক্ষণ পর্যন্ত না রোগী কাবু হতো। এই ছিলো মোটামুটি মিশেল ফুকোর পাগলামি আর সভ্যতার সার সংক্ষেপ।

লিখেছেনঃ- Abu Obaid

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ