এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বিপুলবাবুর স্বর্গ লাভ



(একটি বাজে কল্প বিজ্ঞানের গপ্প)

আর পাঁচটা বাঙালি মধ্যবয়সি মানুষের মতো বিপুলবাবু একটা গড়পড়তা জীবন যাপন করতেন।না বলা ভুল, একটু আলাদা ছিল তার জীবন।তিনি ঈশ্বর বিহীন এক মানুষ এবং বিজ্ঞান ভালোবাসা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চাকরি বা অবসরের পরের সময়েও কাজ করে চলেছিলেন।তেমনি এক জনসচেতনতার এক সভা শেষে দক্ষিণ কলকাতা থেকে তার রাজারহাটের বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য একটি বাসে উঠেছিলেন।আজ শনিবার হওয়ার কারণে অনেক অফিস ছুটি তাই জানলার ধরে জায়গা পেয়ে একটু উৎফুল ও হয়ে উঠলেন।হালে ফেসবুক বা অন্য সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার কারণে জিনিসটি বেশ ভালো বেসে ফেলেছিলেন তাই একটু মনের মতো সিট্ পেয়ে আয়েস করে স্মার্ট ফোনে ফেসবুকে ঢুকলেন।


এক পর্যায়ে বোধহয় চোখ একটু লেগে গিয়েছিল,আত্বস্থ হতেই চমকে উঠলেন।এ কোন জায়গা!তিনি পরিচিত বাসে তো নেই, আশেপাশে কোনো আসবাব বা অন্য কিছু দেখছেন না তবে বসে আছেন ওটা বুঝতে পারছেন।চারিদিকে যে আলো ছড়িয়ে পড়েছে ওটা বেশ মনরম আর বাসের সেই ভ্যাপসা গরমের বদলে একটা অতীব আরামদায়ক তাপমাত্রা বিরাজ করছে।বিজ্ঞান জানা বিপুল বাবু অলৌকিক কিছুর উপরে  ভরসা করেন না তাই একটু নিজের গায়ে চিমটি কাটলেন।উফ, বেশ লাগলো, তবে!এ কি হচ্ছে? সহসা মৃত্যু ভয় মনে এলো।এতদিন কি তবে যা ভেবেছেন সবই ভুল? সত্যি কি মৃত্যুর পরে কিছু আছে? তার বাড়ির লোকের কি খবর, কি ভাবে তিনি এই অবস্থায় এলেন এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা নরম অথচ প্রায় আবেগহীন পুরুষ কন্ঠ শুনতে পেলেন।
"নমস্কার বিপুল বাবু , ভয় পাবেন না, আপনি ঠিক আছেন, আপনার মৃত্যু হয় নি "

বিপুল বাবু আরো চমকালেন "আপনি কে মশাই ? আর আমিই বা কোথায় ?"

সেই কন্ঠস্বর আরো মোলায়েম ভাবে বললো" আমাকে আপনি চিনবেন না, আর নাম বা অন্য কোনো পরিচয় দিলেও তার হয়তো আপনার ভাষাতে ঠিক অর্থবহ হবে না "

বিপুল বাবু অতীব ত্যাদড় লোক তাই বলে উঠলেন "আরে মশাই, আমি এইখানে এলাম কি করে? দিব্বি বাংলা বলছেন আর সামনে আসছেন না কেন? যদি ভেবে থাকেন আমার কাছে টাকা অনেক তা হলে আপনার ভুল হয়েছে।আমার কাছে তেমন কিছু নেই ,যে কটা টাকা আছে তাতে আনার পরিশ্রম বেকার যাবে বলে দিলাম "
অদৃশ্য সেই কণ্ঠ একই ভাবে অতি মোলায়েম করে উত্তর দিলো " আপনার পকেটে আছে তিনশো সাতাশ  টাকা যার মধ্যে তিনটি একশোর নোট ,সঙ্গে দুটো দশ টাকা আর সাত টাকা খুচরো।আপনি কোনো ক্রেডিট কার্ড রাখেন না, ডেবিট কার্ড আছে তাতে আপনার সেভিংস এ আছে হাজার তিরিশেক টাকা।এ ছাড়া আছে পকেটে গোটা পাঁচেক সিগারেট ,উইলস নেভি কাট ছোট।"

বিপুল বাবু এবার চমকালেন। ব্যাটারা এত জানে কি করে ? পকেট হাতড়েছে ঠিক আছে কিন্তু ব্যাংক ব্যালেন্স!যদিও এই একাউন্ট বেশি টাকা নেই তবু জানে কি করে! রাজারহাটের পৈতৃক বাড়ির উপর দু একটা প্রোমোটার ছোঁক ছোঁক করছিল নিশ্চই ব্যাটারা এদের লাগিয়েছে।এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আবার সেই কন্ঠস্বর বলে উঠলো "না , আপনার প্রোমোটার বা অন্য কেউ কিছু বলে নি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন "

এবার বিপুল বাবু আরো চমকালেন,হচ্ছে কি? যাইহোক , চিরকাল ফৌজে মানে বিমান বাহিনীর কর্মরত মানুষ হিসেবে অনেক পরিস্থিতি সামলেছেন তাই মুখে প্রকাশ করলেন না। একটু অস্বস্থি বোধ করছেন ,একটা সিগারেট যদি  ...এই ভাবতে ভাবতে আবার সেই কন্ঠস্বর বলে উঠলো " আপনি সিগারেট খাবেন ? আপনার সামনে টেবিলে আপনার সিগারেট আর লাইটার আছে , আপনি ধরিয়ে নিন "

আর অবাক হতে ইচ্ছা করছে না।বিপুল বাবু ধরিয়েই ফেললেন, " না , ভুত বা অন্য কিছু না তা হলে, কিন্তু আমার থেকে চায় কি ?  " এই ভাবনার পরেই আবার সেই কন্ঠস্বর বলে উঠলো " হ্যা , ঠিক , আসুন একটু বলেই ফেলি আমরা কি চাই "

আমরা ? বিপুল বাবু কৌতূহলী হলেন

হ্যা , আপনি এক অন্য মাত্রার জগতে আছেন।আপনাদের পরিচিত জগতের থেকে একটু এগিয়ে আমরা আর তাই আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি "

বিপুলবাবু টানটান হয়ে বসলেন ,ঠিক শুনছেন তো !
অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে উঠলো " হ্যা , আপনি ঠিকই শুনেছেন , আমরা আপনার সাথে কথা বলছি আপনার মস্তিষ্কের মাধ্যমে যোগাযোগের মাধ্যমে
"
তা আপনারা ঠিক কি চান ? বিপুল বাবুর গলা একটু ক্ষীণ এবার
চিন্তা করবেন না ,আমরা আপনার ক্ষতি করতে চাই না।আমাদের ও আপনাদের মতো এক বিশাল যন্ত্র গণকের সংযোগ আছে।সভ্যতার যে পর্যায়ে আছি ওটা আপনাদের ভাষায় স্কেল ওয়ান এর একটু উচ্চ মাত্রা আর সভ্যতার এগিয়ে থাকা হাজার পাঁচেক বছরের।

বলেন কি!"বিপুলবাবু এবার অতীব বিস্মিত

হ্যা , তবে একটা সমস্যা আমাদের এসেছে তাই আপনার মতো বেশ কিছু মানুষের স্মরনাপন্ন হয়েছি আমরা।

বিপুলবাবুর বিস্ময় যেন এপেলো মহাকাশ যানের উপরে চলে গেল , "আপনারা আমাকে চাইছেন আপনাদের সমস্যার জন্য!আমি মানে আমি তো কোনো বিজ্ঞানী ও না স্যার , স্রেফ এয়ারফোর্সে লজিস্টিক সেকশন দেখতাম" বিপুল বাবু এবার অতীব শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলেন।
"না না, আপনাকে কোনো গবেষণার কাজে দরকার বলি নি, এমন কি এই সমস্যায় আপনাকে একা ও খুঁজি নি।আমাদের দরকার আপনার এই বয়েসের বেশ কিছু লোক যারা ঠিক কয়েক প্রজন্মের আগের অভিজ্ঞতা আবার বর্তমান অবস্থা নিয়ে ওয়াকিবহাল।একই সাথে বিজ্ঞান সচেতন আর মানসিক এবং শারীরিক ভাবে স্বক্ষম।"

"এই রকম তো অনেক লোক আছে স্যার , তবে আমি কেন ?" বিপুল বাবু একটু পালাতে চাইছেন যেন

কণ্ঠস্বর একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলো " হ্যা , আমরা জানি ,তাই  আমরা একটি বয়েসের অনেক লোকের সাথেই এই যোগাযোগ করছি "
আপনারা কি চাইছেন ? " বিপুল বাবু একদম অথৈ সাগরে পড়ার মতো করে বললেন

"দেখুন , বিষয়টা আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলা দরকার , আমাদের গ্রহে আপনাদের মতো এক সময়ে এই ধর্মের কারণে বা নানান বৈষম্যের কারণে অনেক প্রাণ নষ্ট হয়েছে। এক পর্যায়ে আমরা এর বাইরে যেতে পেরেছি। আপনাদের আজকের এই শুরুর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধাঁচে আমাদের উন্নতি ও হয়েছে অনেক। আজ আমাদের গ্রহে কোনো কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতে যন্ত্রেই হয়ে যায় কিন্তু   ...." কণ্ঠস্বর একটু বিরতি নিলো।


কিন্তু কি ? বিপুলবাবু প্রবল আগ্রহী

কন্ঠস্বর বলে চলে " কিন্তু,আমাদের এই সভ্যতার এক পর্যায়ে আমরা দেখলাম আমাদের আপনাদের মতো নানান মননের প্রকাশ মানে ছবি ,গান বা সাহিত্য এই সব নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামাচ্ছি না , আমরা আপনাদের আজকের দেখা এই ভার্চুয়াল জগৎ মানে কল্প লোকের নানান অবস্থা তৈরী করেছিলাম , যাতে আপনি বাস্তবের সব রূপ পাবেন। ভেবেছিলাম এর প্রয়োগ করে হয়তো আজকের আমাদের জগতে সেই মননের ফিরিয়ে আনার কাজ করতে পারবো। কিন্তু পারি নি,আমাদের বর্তমান গণক যন্ত্র গুলো দেখিয়েছে যে আগের অভিজ্ঞতা না থাকলে এই অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি পাওয়া মুশকিল। আমাদের পুরো প্রজন্ম যন্ত্রের মতো হয়ে যাচ্ছে ফলে সভ্যতা বা আগামীর উন্নতি আটকে যাবে। যেহেতু যন্ত্র বা এই গণক গুলো এই ভাবেই তৈরী যে ঐগুলো আমাদের জায়গা নিতে পারবে না তাই ক্রমাগত উন্নতি আটকে যাওয়ার দশা হচ্ছে।

আপনারাই বা এই ভার্চুয়াল জগৎ মানে কল্পজগৎ দিয়ে কি উন্নতি করাতে চাইছেন ? বিপুলবাবু এবার বেশ বিষয়ে আগ্রহী

-দেখুন,আনার পুরো জীবনপঞ্জি আমরা দেখেছি ,মানে আপনার মতো এই কয়েকটি ধাপের সময়ের অভিজ্ঞতা পাওয়া মানুষরা বিজ্ঞান যেমন বোঝেন তেমনি চারুকলা ইত্যাদি ও বোঝেন। আমরা আপনাদের এই উপলব্ধির একটা ম্যাপিং মানে তথ্যপঞ্জী ধরে এর পুরো পদ্ধতি বুঝতে চাইছি। আমাদের গণক আপনার নিজের স্মৃতির ভিত্তিতে ওই কল্প জগৎ তৈরী করেছে। এখন খালি আপনার অনুমতি পেলে আপনাকে সেই জগৎ এ নিয়ে আপনার মানসিক ভাব গুলো ম্যাপিং করতে চাই। তাতে আমাদের পরবর্তী গবেষণার অনেক উপকার হবে।

"আমার উপলব্ধি আপনাদের কি ভাবে উপকার করবে ?" বিপুলবাবু সহজে ছাড়ার লোক না

আপনার ওই জগতে ঢোকার পরে প্রত্যেকটি মানসিক ভাব আমরা রেকর্ড করবো আর আপনার অভিজ্ঞতা কে পুঁজি করে আমাদের গ্রহের বাসীরা সেই ভাব কে নিজের মধ্যে পাবে। ওটা ই আমাদের একমাত্র রাস্তা ,আপনি অনুমতি দিন !

বিপুল বাবু তবু জিজ্ঞাসা করে " কিন্তু আমার বাড়ি আছে ,আমার স্ত্রী ,মা ছেলে আছে। কত দিন আপনারা আমাকে আটকে রাখবেন ? তাদের কি হবে ? "

কন্ঠস্বর একটু হাসির রেশ ধরে বলে " আপনি চিন্তা করবেন না , এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা স্রেফ কিছু মিনিটের তাই আপনাকে কোনো অসুবিধে পেতে হবে না। "

আমার কোনো শরীরে ক্ষতি ? মানে এই কোনো রেডিয়েশন আছে নাকি ? বিপুলবাবু সতর্ক

"না , আপনার এই অভিজ্ঞতা পুরোই আপনার মস্তিষ্কের , এমন কি আজকের আপনাদের এই চোখের সামনে কোনো বস্তু লাগানো বা চশমা ইত্যাদি অথবা কোনো তারের আর দরকার নেই ,আপনি খালি একটু আপনার স্মৃতির থেকে আপনার ছেলেবেলার কিছু সুখকর অভিজ্ঞতা বা অন্য কিছু ভাবুন , বাকি কাজ আমাদের যন্ত্র করবে "

বিপুলবাবু চোখ ,বুজলেন  সুখের স্মৃতি ? তা তো কতই আছে , আহা , সেই স্কুলের দিন গুলো বা সেই যে কয়লার ইঞ্জিন , আত্বিয়ের বাড়ি। সব যেন এক সাথে ভেসে আসে।

কি আশ্চর্য ! এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি দেখলেন সেই তার বনগাঁর গ্রামের বাড়ি। আজ স্কুল থেকে ফিরেছেন , ওই তো গ্রামের রায় বাড়ির বড় কর্তা পুকুরে  জাল ফেলেছেন বোধহয় ওদের কোনো আত্বিয় এসেছে। তার সেই ঢলঢলে হাফপ্যান্ট আর সেই স্কুলের টিনের বাক্স , সেই গ্রামের মেঠো রাস্তা।আহা, কি আনন্দ যে লাগছে !

বিপুল!  বিপুল! কে ডাকে তাকে? আরে গ্রামের সেই এক কোনায় থাকা বৈরাগী বুড়ো না? আবার কি জানি ফরমায়েশ করবে।
-বাবা, দে না একটু ওই বাগানের ছাগল টা কে তাড়িয়ে, চলতে যে পারি না,

-কত বলেছি তোমাকে একটু বাগানের দরজা দিয়ে রাখো , এই হ্যাট হ্যাট  ....বিপুলবাবু তার ছোট্ট হাতে ঢিল দিয়ে ছাগল তাড়ায়।আহা মানুষটা একা থাকে,এক অদ্ভুত মায়ায় মন ভরে যায় তার।

মনে এলো, আজ না গ্রামের মাঠে যাত্রা হবে।বাবা কি যেতে দেবে, কি দারুন হ্যাজাক আলো, ওই তো কারা যেন মাইকে বলছে।পালা তো চেনা, কলকাতার নট্ট কম্পানি বেশ বড়ো, বলছে চাপা ডাঙ্গার বৌ নাকি। আবার যদি বড়দের হয়, বাবা না দিলে নিশ্চই রাঙাকাকা দেবে।বললে না করবে না!

বিপু! বিপু! দূরে মা ডাকছে না?হ্যা, এই রে,বলেছিল আজ হাট থেকে কিছু বাজারের জিনিস নিয়ে আসতে। নকড়ি দাদার দোকানে রাখা আছে ,সব ভুলে মেরেছি।আজ নিশ্চই মার্ খাওয়ার পালা।

এক পলকে কি যে হলো , বিপুলবাবু দেখলেন দূর্গা পুজোর সেই পঞ্চমীর দিন।ওই তো গ্রামের চন্ডি মন্ডপে ঠাকুরের মূর্তি এসে গেছে।মুখ ঢাকা ,বেশ মজা হবে।এবার কলকাতা থেকে তার মাসতুতো ভাইরা আসছে ,দেখুক তাদের পুজোও কত মজার!উফ মেলা বসবে, কত কি যে হবে!

ভাবতে ভাবতেই বিপুল বাবু এক পলকে চলে গেলেন সেই ইছামতির ধারে যে খানে জেলে পাড়ার ছেলেদের সাথে তিনি মাছ ধরতেন।আরে নগেন আজ খাপলা জাল  এনেছে!বেশ হবে, আগের দিন ছিপ ভেঙ্গেছে একটা বড় কালবোস মাছ ধরতে গিয়ে, আজ ব্যাটাকে দেখে নেবো।

ইছামতির পাড়ে ঘাসের উপর বসে, বিপুল বাবু দূরে কোথায় যেন ভেসে আসা মাইকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনলেন।আহ আজকের দিনটা কি সুন্দর!

পাশের নগেন কে জিজ্ঞাসা করলেন" হ্যা রে , আজ কারোর বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে নাকি রে ? "

ওমা তুই কি রে ! আজ যে আমাদের টেপির বিয়ে রে!কলকাতা থেকে ভিয়েন বসবে।পুরো পাড়া তো যাচ্ছে , তুই কি রে! "

এতো সুখ , এতো আনন্দ, আজকের দিনটা অসাধারন।বিপুল বাবু থেই হারিয়ে ফেলতে লাগলেন যেন।

আবার এক ঝটকায় তিনি যেন চলে গেলেন তার বাড়ির অঙ্গনে , আরে ওই তো দাদুর মৃত দেহ , বাবা কাকা কাঁদছেন, কত মানুষ এসেছে ভিড় করে।দাদু মারা গেলেন, মরে গেলে লোকে কোথায় যায়? কার সাথে খেলবো, কত ভাবনা কত স্মৃতি।না মনটা ভালো লাগছে না।বিপুল বাবু একটু দূরে সরে আসেন।

আবার পৃথিবী যে অন্য হয়ে গেল, ওই তো পুতুল নাচের আসর।কত আশা করে বসে ছিলেন আলাদিন আর আশ্চর্য প্রদীপ দেখার এই আসর দেখতে।হ্যাজাকের সেই আলো , কি সুন্দর সব পুতুল গুলো।ওই কারা কি সুন্দর করে গান করে করে কথা বলছে।আজ কি ঠান্ডা একটু বেশি,পৌষ মাসের আসর,বিপুলবাবু তার কাকার চাদরে একটু ঘন হয়ে আসেন।কাল কি আবার স্কুল? না, এখন তো শীতের ছুটি।কাল সক্কাল বেলা খেজুর রস পাড়ানো হবে ,বাবা বলেছে।চোখ যেন জুড়িয়ে আসছে  .......

এক মুহূর্তে বিপুল বাবু দেখলেন আবার সেই চেয়ার সেই ঘর। তা হলে কি এই সব সেই কল্প জগৎ ? কই বুঝতে তো পারেন নি!
কণ্ঠস্বর বলে ওঠে"আমাদের বড় এক ধাপের কাজ হয়েছে, আপনার সাহায্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ!"

বিপুলবাবুর ঘোর তখনো কাটে নি এরই মধ্যে এক অতীব পুরোনো প্রশ্ন মাথায় চলে আসে, জিজ্ঞাসা করেই ফেলেন , "আচ্ছা ,আপনাদের এই পাঁচ হাজার বছরের এগিয়ে থাকা সভ্যতায় বামপন্থার ফিরে আসা কি হয়েছে ? মানে,সবার জন্য সাম্যতা? ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ?

সেই কণ্ঠ ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে একটু যেন হেসে বলে "কায়িক পরিশ্রমের ধাপ পেরিয়ে মেধা ভিত্তিক এক সীমিত জন গোষ্ঠী কাজ করে নিজেদের মানসিক উন্নতির জন্য, তাই আপনার এই মতবাদের তো প্রয়োজন আমাদের হয় না,সত্যি বলতে ওটা ফুরিয়েছিল সভ্যতার কয়েকশো বছরের মধ্যেই।সম মেধা বা একই ধরণের ক্ষমতার জীব তৈরির কোনো পদ্ধতিতে আমরা যাই নি, কারন তাতে যন্ত্রের তৈরী হয় ,বৈচিত্র থাকে না।আর প্রত্যেকটি জীবই তো নিজের গুনে অনন্য।আমাদের সভ্যতা এখন আত্বসচেতন এক জীব গোষ্ঠীর সমাজ।ব্যক্তি স্বাধীনতা আর মননের কোনো বেঁধে ধরে রাখার পথ আমরা ত্যাগ করেছি অনেক শতক আগে।

বিপুল বাবু প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন "তবে কি ধনতন্ত্রই চলবে!"

অলখ সেই কণ্ঠস্বর একই ভাবে অবিচল কণ্ঠে বলে উঠলো "ধনতন্ত্র কি আপনাদের সময়েও আছে? যা আছে তা একটা বৃহৎ বাজার অর্থনীতি, তবে আমাদের সময়ে ওটা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে আরো পরিশীলিত অনেক বেশি জাগতিক উন্নতির কল্পে করা এক সতত পরিবর্তনশীল কাঠামো।শোষণ তো ঐভাবে আর নেই তাই পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের কাজ ক্রমাগত উত্তরণের।আপনারাও এই পথেই যাবেন বলে আমরা মনে করি।"

বিপুলবাবু যেন এক হাজার ভোল্টের শক খেলেন , শুদ্ধ বাংলায় যেন চিত্রার্পিত অবস্থা লাভ করলেন।

সেই কণ্ঠ যেন একটু সদয় কণ্ঠে বলে উঠলো "আপনার হয়তো এই গুলো মানসিক ধাক্কার মতো হতে পারে , হওয়ার কথা কারন এই ভাবে ভবিষ্যৎকে ধারণ করা অতীব কঠিন ,আপনি এই ভাবনা গুলো দূরে রাখুন , কালের স্রোতে যা হওয়ার তাই হবে। আসুন , আপনার যাওয়ার সময় হলো , যাওয়ার আগে আপনাকে একটা ভালো বাসার কিছু দিয়ে যাব , হয়তো ভালো লাগবে "
এরপর একটা ছোট্ট নীরবতা, একটু সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার এক অবস্থা যেন।

কি দিয়ে গেলো বোঝার প্রশ্ন করার আগেই কে যেন তার শরীরে ধাক্কা দিতে থাকে, "ও দাদা , উঠুন ডিপো এসে গেছে , আর কত ঘুমাবেন! "
নিজেকে ফিরে পান বিপুল বাবু ,তার পরিচিত সেই বাসের ডিপো।তা হলে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন ?

কিন্তু এই কিরকম স্বপ্ন ? যাই হোক বাস্তববাদী বিপুল বাবু একটু খুশিই হলেন যেন। পকেট হাটকে মানিব্যাগ থেকে সিগারেট এমনকি দেশলাই সব একই আছে দেখে মনে মনে হেসেই ফেললেন।বেশ একটা ভালো স্বপ্ন যা হোক।

বাঁ দিকের পকেটে আনমনে হাত দিয়ে যেন কি একটা হাতে লাগলো , হাতে নিয়ে দেখলেন, আরে!এটা কি ?

একটা সাদা কালো ছবি,তার কৈশোরের,সেই ইছামতির ধারে রাঙ্গাকাকার আগফা ক্যামেরায় তুলে দেওয়া ছবি,কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল,আজ কি ভাবে ফিরে পেলেন!

স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই বিপুল বাবু আকাশের দিকে হাত তুলে কাকে যেন নমস্কার করলেন  .....

সব চরিত্র বা কাহিনী কাল্পনিক তাই বাস্তবের সাথে মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন না !

লিখেছেন-আজিজুল সাইজী।

next post

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ