সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পারিবারিক আইন বা ধর্মীয় আইনে নারীর অবস্থান

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও ব্যাক্তিক আইন নামে দুই ধরনের আইন বিদ্যমান। প্রথমটি রোমান আইনের ভিত্তিতে রচিত এবং দ্বিতীয়টি বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থের ভিত্তিতে রচিত। হিন্দু, খৃষ্টান, মুসলিমদের জন্য স্ব স্ব ধর্মীয় আইন বিদ্যমান। আজ পর্যন্ত ব্যাক্তিক আইনের কোনো সংস্কার সাধন হয়নি, ফলে ঐতিহাসিকভাবে এই আইন নারী পুরুষের ক্ষেত্রে অসমই থেকে গেছে। হত্যা, ধর্ষন, অপহরণ ইত্যাদি নিপীড়নের চরমতম ক্ষেত্র বাদে অধিকাংশ নারী নিপীড়ন ও নির্যাতন ক্ষেত্র যেমন সম্পত্তি নিয়ে কলহ, তালাক ও বহুবিবাহ এ সবই ব্যক্তিক আইন আইনের পরিসরে গণ্য করা হয়। এই সকল তথা কথিত "ব্যাক্তিক" আইন ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রীয় জগতে প্রবেশ করে তখনই যখন নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে নতুবা নারী এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে তখন। এ ক্ষেত্রে সমাজ অধিকাংশ সময় ধামা চাপা দেয়ার কৌশল অবলম্বন করে। ব্যক্তিগত কোনো বিষয় যেন কখনোই রাজনৈতিক ভাবে প্রকাশিত না হতে পারে তার জন্য সবাই সোচ্চার থাকে।


অনেক সামাজিক নিয়ম, ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় নীতি আছে যা অনেক ঘটনাকে ব্যক্তিগত, লজ্জাজনক এবং প্রকাশ করা উচিৎ নয় বলে মনে করে। এটা আশ্চর্যজনক নয় যে এ ধরণের ঘটনা অধিকাংশ নারী সংক্রান্ত।  যার ফলে একজন গৃহবধু নিজের উপর তার স্বামীর পিটুনিকে "ব্যাক্তিগত" ব্যাপার বলে মনে করেন। সর্বোপরি ধর্মমত স্বামীদেরকে স্ত্রীদের উপর কর্তৃত্ব করার কিছু ক্ষমতা দিয়েছে। একটি প্রচলিত বাংলা প্রবাদ " স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেশত" যা কিনা সেই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ়বদ্ধ করে। অপর দিকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পুরুষকে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং নারীর আয়কে পরিবারের সহায়ক বলে চিহ্নিত করা হয়। খেয়াল করে দেখবেন কিছু সময় রাস্তায় একজন নারীকে অপদস্ত করা হলে নারী প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করতে চায়না কারণ সমাজে এটাকে লজ্জার ব্যাপার বলে মনে করা হয়, উপরন্তু সেই নির্যাতিত নারীই লজ্জা অনুভব করেন এবং ঘটনার জন্য নারীকেই দায়ি করা হয়, এই প্রবনতা বেশী দেখা যায় ধর্ষনের ক্ষেত্রে।   এই ধরণের মুল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে নিঃসৃত হয়।


বর্তমানে নারী নিপীড়নের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কিছু আইন প্রচলিত আছে, সরকার কর্তৃক এই সমস্ত আইন সংগঠিত অপরাধের শাস্তির বিধান করে থাকে সত্য, কিন্তু নারীদের অধস্তন অবস্থার পরিবর্তন বা প্রতিবাদ করেনা। এ ধরণের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে পারিবারিক আদালত, যা গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক কলহ ও বিরোধের অবসান ঘটানো এবং দাম্পত্য শান্তি বজায় রাখা। কিন্তু আইনকে ফাঁকি দেওয়ার অনেক ফাঁক-ফোঁকরও এখানে আছে, যেমন- অধ্যাদেশে উল্লেখ আছে যে, যদি অভিযোগকারী মামলার শুনানির সময় অনুপস্থিত থাকেন তবে আদালত মামলা খারিজ করে দিতে পারে।

তাই যে নারী তার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করেন তার স্বামী হুমকির মুখে তাকে আদালতে অনুপস্থিত রাখতে পারেন।
অন্য কথায় বলা যায়,  যতদিন সামাজিক সমপর্কে নারীর অধস্তনতা বিরাজ করবে ততদিন শুধুমাত্র  আইনগত প্রক্রিয়া দ্বারা তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাছাড়া পারিবারিক আদালত বিভিন্ন জোড়াতালির মাধ্যমে বিরাজমান অসম সমাজ ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখে,  ফলে সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থান অপরিবর্তিত রয়ে যায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু মতাদর্শগত পরিবর্তন হয়। প্রার্থমিক ভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র,  জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  কিন্তু ১৯৭৮ সালে এতে সংশোধনী আনা হয় এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার জায়গায়,  "আল্লার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা" এই কথাটি স্থাপন করা হয়। এখানে ইসলামীকরণের একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়।  এই পদক্ষেপে তেল সমৃদ্ধ ইসলামী দেশগুলো থেকে ইসলামী ভাতৃত্বের স্লোগান ব্যাবহার করে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গেলেও এর প্রবণতা নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।  কেননা, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের স্থলে, ইসলামী মূলবোধ শক্তিশালি হয়েছে এবং নারীর সনাতন ইমেজ গুলো সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। যেমন,  মা, কন্যা, বোন ইত্যাদি। এই সনাতনী ইমেজ নারীদের তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে রাখে।

এই ধর্মীয় আইনের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত নারীর জন্য বৈষম্য দূরীকরণ ও তার দক্ষতায় নের সনদ 'সিডও'  বিলে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করলেও শরিয়তি আইনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় বলে দাবি করে জাতিসংঘের নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদের সবগুলো ধারা অনুসরণ না করার শর্তে স্বাক্ষর দান করেন। উল্লেখ্য দুটি ধারাতে বাংলাদেশ সরকার আজও অনুমোদন দান করেননি,  ১। পিতার সম্পত্তির উপর ছেলে মেয়ে উভয়ের সমানঅধিকার, ২।  বিবাহ আইনে নারী পুরুষের সমানঅধিকার।


এই সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়,  ধর্মীই আইনের কারণেই নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূরীকরণ আন্তর্জাতিক  সনদে বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি অনুসরণ করেননি। বলা হয়, স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিধান হওয়ার জন্যই নাকি ওই শরিয়তি আইন অনুসরণ করতে হবে!
কিন্তু রাষ্ট্র যদি দৃঢ় অবস্থান নেয় তাহলে এই বিধান অনুসরণ না করলেও চলে। বাংলাদেশের সামাজিক রীতিনীতি, অভ্যাস, ধর্মীয় বিশ্বাস সামাজিক আইনে বিদ্যমান। এখানে আমাদের দেখা দরকার কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এসব অসম নীতিতে সহায়তা করছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এর প্রতিবাদ করার অধিকার দিচ্ছে।

সুমাইয়া
লিখেছেন:সৈয়দা সুমাইয়া ইরা।।
ফেসবুক একটিভিস্ট এবং ব্লগার 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জাতীয়তাবাদ আরেকটি ধর্ম বই

বাংলাদেশীরা ধর্মভীরু। ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও জাতীয়তাবাদ নামক ধর্মগুলোর প্রতি বাঙ্গালীর দুর্বলতা নতুন কিছু নয়। আমরা যারা মুক্ত-চেতনাকে প্রয়োজনীয় মনে করি, যুক্তিকে ধর্মের ওপরে স্থান দেই তাদের অনেকেই ধর্মের মতই সামনে আসা অন্যান্য প্রতিটি ধারনা ও প্রস্তাবনাকেই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাই, খতিয়ে দেখতে চাই। বা দদূএকটি রূপ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম হিসাবে মানুষের দলবদ্ধ সমাজব্যবস্থার দ্বিতীয় বড় চালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রস্তরযুগে আরো একটি ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল। মানুষেরা নিজেদের গ্রাম বা নগরকে কেন্দ্র করে একটি সামষ্টিক পরিচিতি অনুভব করে শুরু করেছিল। বোধ করি তখন থেকেই মানুষের দলবদ্ধতার তৃতীয় চালক জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক যাত্রা শুরু। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদ নানান চেহারায় দলবদ্ধতার সবচাইতে শক্তিশালী চালক হিসাবে বিদ্যমান। একটি নৃগোষ্ঠী যখন পুঁজিবাদী হতে শুরু করে, যখন সে একটি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র গঠন করে তখনই সে একটি জাতিতে পরিণত হয়। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ আমাদের দেশের রাজনীতিতে কাছাকাছি আছে ইতিহাসের শুরু থেকে। মহাভারত থেকে আজকের খালেদা-হাসিনার রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ একে অন্যের হাত...

গাজওয়াতুল হিন্দ

গাজওয়াতুল হিন্দকে বর্তমান বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল শ্রীলংকার জিহাদীরা তাদের মনে আটকে রেখেছে। এই বিষয়ে নানা মতাভেদ থাকলেও সকল মুসলিম জিহাদীরা মনে করে বা আ শা করে যে ইসলাম সারা পৃথীবিতে এই জিহাদের মাধ্যামে প্রতিষ্টা হবে। তারা এটাকে মর্যাদার্পূণ জিহাদ বলে মনে করে। ইসলামের ভিত্তির অন্যতম হলো জিহাদ। ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালীন প্রচুর যুদ্ধ করা এবং হত্যার পরেই মানুষ ভয়ে ইসলামকে গ্রহন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ভায়রাস বলা হয় ইসলামকে। এই ভায়রাস আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে গাজওয়াতুল হিন্দকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে জিহাদীরা তাদের দলে লোক বেসি করার জন্য অনলাইনে সহ নানা জাগাতে ঠিক এই ভাবে মুসলিমদের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে "গাজওয়াতুল হিন্দ বা ভারতবর্ষের যুদ্ধ সম্পর্কে কি আপনি অবগত? আপনি কি কাফের মুশরিকদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত?" ইসলামীষ্ট  জিহাদীরা ঠিক এভাবে চাই যে সারা পৃথিবীতে সবচে’ বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটা হবে হিন্দুস্তান তথা ভারতের হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের যা সমস্থ জ্ঞানি ইসলামি স্কলার এবং আলেম উলামা জানে। মুসলমানদের জন্য এটা খুব বড়  জিহাদ এবং এই জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই...

বাঙালি এবং লেখকের জীবন

লেখকের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত তার পরিবারের স্বীকৃতি।এখানে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে-লেখালেখি যে একটি কাজ,অন্য মতোই একটি কাজের, এবং সেই কাজের জন্য মনোযোগ,সময় এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়-এই বোধটা তৈরী হওয়া।লেখালেখিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে নাই বা ধরা হলো। কিন্তু এটি যে একটি কাজ,এই স্বীকৃতিটা পরিবার থেকে আসা খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বান লেখক শেষ পর্যন্ত যে লেখক হয়ে উঠতে পারে না,লেখক জীবন যাপন করতে পারেন না,লেখালেখির জগত থেকে তাদের যে অকাল বিদায় নিতে হয়,তার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।লেখালেখিকে পারিবারিক ভাবে স্বীকৃতি না দেওয়া।দেশের অন্য সব মানুষদের মতোই বেশির ভাগ পরিবারে লেখালেখি একটি নেহাৎ ই শখের জিনিস।তারুণ্য বা অংকুরোদ্গমী যৌবনে যৌনতার চুলকানিরও পেয়ে বসে আমাদের দেশের মানুষদের।তখন তাদের লেখাকে বাবাহা দেয় বাড়ির ভাবীরা,কাকা-জ্যাঠারা,সহপাঠীরা,বা তার কোন প্রেমিক-প্রেমিকাও।কখনো কখনো এমনকি বাবা মাও।তারা সকলেই অবচেতনে,এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে,এই চুলকানি বেশিদিন থাকবে না।কিন্তু যার ক্ষেত্রে থেকে যায়,অর্থাৎ যে বুঝে যায় যে লেখক হওয়াটাই তার ভবিতব্য,সমস্যাটা তার ক্ষ...