সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্তন কর কি এবং কেন?

স্তন কর কি এবং জানতে নিচের ভিডিওটা দেখতে পারেন।


মূলতঃ
দক্ষিণ ভারতের নিম্ন-বর্ণের হিন্দু মহিলারা গায়ে বিশেষ করে বুকের ওপর কোন কাপড় পরিধান করতে পারতো না। তাদের স্তনকে উন্মূক্ত রাখতে হতো সবসময়। আর যদি তাদের বুকের ওপর কোন কাপড় পরিধান করতে ইচ্ছা পোষণ করতো তবে তাদেরকে স্তন কর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। এই রকম একটি আইন বা নিয়ম উনিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারতে চালু ছিল। আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য অনেক নিম্ন-বর্ণের হিন্দু মহিলা অনেকটা বাধ্য হয়েই এই বর্ণ ভিত্তিক স্তন কর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স প্রদান করতো।


স্তন কর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্সের ধরণ কেমন ছিল?


যেসব নিম্ন-বর্ণের হিন্দু মহিলার স্তন ছোট ছিল তাদেরকে অল্প কর বা অল্প ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। কিন্তু সমস্যা ছিল ঐ সমস্ত মহিলাদের যাদের স্তনের আকার ছিল বড়। তাদের বড় আকারের স্তনের জন্য বেশি পরিমাণ কর বা ট্যাক্স প্রদান করতে বাধ্য করা হতো।

এই আইন কী সবার জন্য প্রযোজ্য ছিল?


এই আইন সব হিন্দু মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। যারা উচ-বর্ণের ব্রাহ্মণ শ্রেণির মহিলা ছিল তাদের এই কর বা ট্যাক্স দিতে হতো না এবং তারা বুকের ওপর কাপড় পরিধান করার একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করত। সমাজের উঁচু শ্রেণির কিছু ব্যক্তি ও তাদের সহযোগী বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু অংশের লোকেরাই এই আইন প্রয়োগ করে মূলত নিম্ন-বর্ণের মানুষদের শাসন ও শোষণ করতো।

এই কর বা ট্যাক্স কারা ভোগ করতো?


হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজের উঁচু শ্রেণির কিছু ব্যক্তি ও তাদের সহযোগী বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু অংশের লোকেরাই আদায়কৃত এই স্তন কর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্সের একটি অংশ ভোগ করতো। আর এর বড় অংশই চলে যেতো বিখ্যাত পদ্মনাভ মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে। এই পদ্মনাভ মন্দিরটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির হিসেবে বিবেচিত যা গিনেস বুকে উল্লেখ করা আছে।এই বর্ণ বৈষম্যের ফলে ঐ অঞ্চলে কী ঘটেছিল?

ভারতে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে নিম্ন বর্ণের নারীদের স্তন আবৃত করতে বা ঢেকে রাখতে অনেক কষ্ট ও অবর্ণনীয় দুঃখ সহ্য করতে হয়েছে এবং সন্মান ও আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য তাদের বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে।

পদ্মনাভ মন্দিরের পুরোহিতরা দাবী করে এবং স্পষ্ট করে বলে যে,নিম্ন বর্ণের হিন্দু মহিলারা তাদের শরীরের উপরের অংশ বিশেষ করে বুক ঢেকে রাখতে পারবে না। তাদের মতে এটি ধর্ম বিরোধী কাজ।

কিন্তু নাংগেলীর মৃত্যুর পরে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে এর বিরুদ্ধে জোরালোভাবে আন্দোলন শুরু হয় এবং ট্রাভানকোরে স্তন কর বাতিলের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ১৮৫৯ সালে ট্রাভানকোরে ব্যাপক দাঙ্গা সংঘটিত হয় এবং এতে বহু মানুষ নিহত হয়। এই দাঙ্গার মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু নিম্ন বর্ণের নারীদের বুকের উপর কাপড় পরিধান করার অধিকার ভোগ করা। এই দাঙ্গাটি কাপড়ের দাঙ্গা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে।

অবশেষে জোরালো প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে ট্রাভানকোরের স্তন কর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স প্রদান আইন রহিত করা হয় এবং নাংগেলীর বসবাসের স্থানটি মুলাচিপারাম্বু বা স্ত্রীত্ব নারীর ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

আক্ষরিক অর্থে এই ঘটনা নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিবাদ হিসাবে দেখা গেলেও আসলে এই লড়াইকে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের বিপক্ষে উচ্চ বর্ণের ব্রাক্ষণ সমাজ, জমিদার বা সামন্ত রাজাদের নিপীড়িত কর আরোপ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।কে সেই মহিলা যে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন?

মহিলার নাম ছিল নাংগেলী। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের ট্রাভানকোর রাজ্যের চেরথালায় বাস করতেন নাংগেলী নামের নিম্ন-হিন্দু বর্ণের এজহাভা গোত্রের এই মহিলাটি। তার স্বামীর নাম ছিল চিরুকান্দান। নাংগেলী ও চিরুকান্দান দম্পতি ছিল নিঃসন্তান। তারা ছিল অতি সাধারণ মানুষ। চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতো।

সেদিন কী ঘটেছিল?


অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ট্রাভানকোরের স্থানীয় শুল্ক কর্মকর্তা, যে কিনা স্তন কর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতো, সে নাংগেলীর বাড়িতে এসেছিলো নিম্ন বর্ণের হিন্দু নারীদের বুকে কাপড় পরিধান করা বা না করা বিষয়টি জরিপ করতে এবং ব্রেষ্ট ট্যাক্স সংগ্রহ করতে। কর্মকর্তা দেখতে পেলো যে নাংগেলী তার বুকে স্তনের ওপর কাপড় পরিধান করে আছে। কর্মকর্তা নাংগেলী থেকে এজন্য কর দাবী করলো এবং তাকে বারবার কর পরিশোধের জন্য চাপ দিতে লাগলো। কিন্তু নাংগেলী স্তন কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এভাবে দিনের পর দিন শুল্ক সংগ্রাহক তার বাড়িতে এসে শুল্কের দাবী আদায়ে চাপ প্রয়োগ করতে লাগলো এবং বিষয়টি মন্দিরের পুরোহিতদের এবং স্থানীয় উচ্চ বর্ণের ব্রাক্ষণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। শুল্ক কর্মকর্তা শুল্ক প্রদানের জন্য নাংগেলীকে আরো বেশী চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং তাকে অতিষ্ট করে তুলে। এদিকে দিনের পর দিন করের বোঝাও বাড়তে থাকে।

অবশেষে একদিন নাংগেলী স্তন কর প্রদান করতে রাজি হয়। নির্দিষ্ট দিনে শুল্ক সংগ্রাহকেরা তার বাড়িতে শুল্ক সংগ্রাহ করতে এলে তিনি তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর নাংগেলী ঘরের ভিতর প্রবেশ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার স্তন দুটি কেটে ফেলেন। তারপর রক্তেমাখা কলাপাতায় স্তন দুটি মুড়িয়ে স্তন শুল্ক বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স হিসেবে তার কর্তিত ও রক্তাত্ত স্তন দুটি শুল্ক কর্মকর্তার হাতে তুলে দেন। স্তন কর্তনের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাংগেলীর মৃত্যু হয়।

নাংগেলীর স্বামী চিরুকান্দান নাংগেলীর বিকৃত মৃতদেহ দেখে শোক সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নাংগেলীর শেষকৃত্যে ঝাপিয়ে পড়ে চিতায় আত্মহুতি দিলেন। ভারতে সেটাই ছিল সম্ভবত পুরুষের প্রথম সতীদাহ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জাতীয়তাবাদ আরেকটি ধর্ম বই

বাংলাদেশীরা ধর্মভীরু। ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও জাতীয়তাবাদ নামক ধর্মগুলোর প্রতি বাঙ্গালীর দুর্বলতা নতুন কিছু নয়। আমরা যারা মুক্ত-চেতনাকে প্রয়োজনীয় মনে করি, যুক্তিকে ধর্মের ওপরে স্থান দেই তাদের অনেকেই ধর্মের মতই সামনে আসা অন্যান্য প্রতিটি ধারনা ও প্রস্তাবনাকেই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাই, খতিয়ে দেখতে চাই। বা দদূএকটি রূপ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম হিসাবে মানুষের দলবদ্ধ সমাজব্যবস্থার দ্বিতীয় বড় চালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রস্তরযুগে আরো একটি ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল। মানুষেরা নিজেদের গ্রাম বা নগরকে কেন্দ্র করে একটি সামষ্টিক পরিচিতি অনুভব করে শুরু করেছিল। বোধ করি তখন থেকেই মানুষের দলবদ্ধতার তৃতীয় চালক জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক যাত্রা শুরু। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদ নানান চেহারায় দলবদ্ধতার সবচাইতে শক্তিশালী চালক হিসাবে বিদ্যমান। একটি নৃগোষ্ঠী যখন পুঁজিবাদী হতে শুরু করে, যখন সে একটি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র গঠন করে তখনই সে একটি জাতিতে পরিণত হয়। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ আমাদের দেশের রাজনীতিতে কাছাকাছি আছে ইতিহাসের শুরু থেকে। মহাভারত থেকে আজকের খালেদা-হাসিনার রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ একে অন্যের হাত...

গাজওয়াতুল হিন্দ

গাজওয়াতুল হিন্দকে বর্তমান বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল শ্রীলংকার জিহাদীরা তাদের মনে আটকে রেখেছে। এই বিষয়ে নানা মতাভেদ থাকলেও সকল মুসলিম জিহাদীরা মনে করে বা আ শা করে যে ইসলাম সারা পৃথীবিতে এই জিহাদের মাধ্যামে প্রতিষ্টা হবে। তারা এটাকে মর্যাদার্পূণ জিহাদ বলে মনে করে। ইসলামের ভিত্তির অন্যতম হলো জিহাদ। ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালীন প্রচুর যুদ্ধ করা এবং হত্যার পরেই মানুষ ভয়ে ইসলামকে গ্রহন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ভায়রাস বলা হয় ইসলামকে। এই ভায়রাস আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে গাজওয়াতুল হিন্দকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে জিহাদীরা তাদের দলে লোক বেসি করার জন্য অনলাইনে সহ নানা জাগাতে ঠিক এই ভাবে মুসলিমদের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে "গাজওয়াতুল হিন্দ বা ভারতবর্ষের যুদ্ধ সম্পর্কে কি আপনি অবগত? আপনি কি কাফের মুশরিকদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত?" ইসলামীষ্ট  জিহাদীরা ঠিক এভাবে চাই যে সারা পৃথিবীতে সবচে’ বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটা হবে হিন্দুস্তান তথা ভারতের হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের যা সমস্থ জ্ঞানি ইসলামি স্কলার এবং আলেম উলামা জানে। মুসলমানদের জন্য এটা খুব বড়  জিহাদ এবং এই জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই...

বাঙালি এবং লেখকের জীবন

লেখকের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত তার পরিবারের স্বীকৃতি।এখানে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে-লেখালেখি যে একটি কাজ,অন্য মতোই একটি কাজের, এবং সেই কাজের জন্য মনোযোগ,সময় এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়-এই বোধটা তৈরী হওয়া।লেখালেখিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে নাই বা ধরা হলো। কিন্তু এটি যে একটি কাজ,এই স্বীকৃতিটা পরিবার থেকে আসা খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বান লেখক শেষ পর্যন্ত যে লেখক হয়ে উঠতে পারে না,লেখক জীবন যাপন করতে পারেন না,লেখালেখির জগত থেকে তাদের যে অকাল বিদায় নিতে হয়,তার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।লেখালেখিকে পারিবারিক ভাবে স্বীকৃতি না দেওয়া।দেশের অন্য সব মানুষদের মতোই বেশির ভাগ পরিবারে লেখালেখি একটি নেহাৎ ই শখের জিনিস।তারুণ্য বা অংকুরোদ্গমী যৌবনে যৌনতার চুলকানিরও পেয়ে বসে আমাদের দেশের মানুষদের।তখন তাদের লেখাকে বাবাহা দেয় বাড়ির ভাবীরা,কাকা-জ্যাঠারা,সহপাঠীরা,বা তার কোন প্রেমিক-প্রেমিকাও।কখনো কখনো এমনকি বাবা মাও।তারা সকলেই অবচেতনে,এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে,এই চুলকানি বেশিদিন থাকবে না।কিন্তু যার ক্ষেত্রে থেকে যায়,অর্থাৎ যে বুঝে যায় যে লেখক হওয়াটাই তার ভবিতব্য,সমস্যাটা তার ক্ষ...