এই ব্লগটি সন্ধান করুন

জ্যোতিষবিদ্যা (হস্তরেখাবিদ্যা) অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের মিশ্রণ



আমাদের সমাজের অনেকগুলি কর্ত্তার ভুতের মধ্যে জ্যোতিষবিদ্যা একটি অন্যতম কর্ত্তার ভুত , যা দীর্ঘদিন আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে কর্ত্তার ভুতের মতো , এই কর্তার ভুতকে নিজেরা ঘাড় থেকে ঘাড় ধরে না নামালে নামে না । সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের কুফলের সাঁড়াশি চাপে আমাদের সমাজের দুর্বল হয়ে যাওয়া লোকজন জ্যোতিষবিদ্যার বশীকরণের মধ্যে ঢুকে হাঁকপাঁক করছে । শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিচালিত এই দেশের সংবাদপত্র ও দূরদর্শনের যে কোনো চ্যানেল খুললেই এদের বিজ্ঞাপন আপনার চোখে পড়বেই , ছাড়া রাস্তাঘাট স্টেশান প্রসাবখানা পায়খানা সর্বত্র এদের বিজ্ঞাপণ । কিছু চ্যানেলতো এই ভন্ড ভবিষ্যৎ বিক্রেতা অসৎ জ্যোতিষীদের রাতদিন বসিয়ে রাখে আপনার ভবিষ্যত বিক্রী করতে । মানুষও যেন বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছে ।সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের সাঁড়াশি চাপে দুর্বল নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষ নিজের উপর আস্থা ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে , খাদ্য – বস্ত্র –আশ্রয় – শিক্ষা –স্বাস্থ্যর ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে , মানুষ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য নিজের উপর ক্রমশ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে এবং এই প্রতারক জ্যতিষিদের শিকার হচ্ছে গায়ে-গঞ্জে-শহরে । এখানে শুধু অশিক্ষিতেরা নয় ডিগ্রীপ্রাপ্ত শিক্ষিতেরা পর্যন্ত প্রতারিত হচ্ছে । সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাস সংক্রমণে প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে , এই ভণ্ডগুলিকে জিজ্ঞেস করুন --- আপনারা সব জান্তা অথচ এই করোনা মৃত্যু নিয়ে ভবিষ্যবাণীকরেননি কেনো ? করলে কবে করেছেন ? গরীব অশিক্ষিত দুর্বল লোক জ্যোতিষীর কাছে যেতেই পারে কিন্তু ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লোক কেনো যায় ? আসলে আমরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু ডিগ্রী অর্জন করলেও আসলে আমরা অশিক্ষিতই , তাই ছুটে যাই নিজের ভবিষ্যৎ জানতে কতকগুলি ঠকবাজ জোচ্চোর জ্যোতিষীর কাছে ।



আমার মা ছোটবেলায় আমাদের পাড়ার পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বালী নিশ্চিন্দা গ্রামে কেশবদার ( যাদের নবগ্রহ মন্দির আছে ) কাছে আমার ঠিকুজি করিয়েছিল , ওনার বাবা কাকারাও পেশাদার গণৎকার ছিলেন । কেশবদারা ছিলেন বাবা-মায়ের পুরানো ভিটা অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মীরেশ্বরী থানার প্রতিবেশী এবং বর্তমানে আমরা এক পাড়ায় বসবাস করি । এই কেশবদা পোলিয়তে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন , চিরকাল পঙ্গুত্বের জন্য জীবনে কোনোদিন হাঁটতে পারেননি , অপরের কাঁধে করে চলাফেরা করতেন । উনি কিন্তু পড়াশুনা করেছিলেন ও ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেছিলেন এবং সেই সূত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এই জন্য আমি ওনাকে পছন্দ করতাম । সেই সময় ওইরকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কোনো মানুষ পড়াশুনা চালাতে পারেন তা আমার জানা ছিলনা , এখন অবশ্য দিনকাল অনেক পাল্টেছে । কেশবদা আমার হাত দেখে গণনা করে বলেছিলেন আমার পড়াশুনা ম্যাট্রিকুলেশনের বেশি হবে না্ তা শুনে আমার এমন রাগ হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা । পরে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স করার পর ঐ ঠিকুজি নিয়ে কেশবদার কাছে গিয়েছিলাম এবং ওনাকে আমার এম কম পাশের কথা জানিয়ে ওনার তৈরি ঠিকুজি শত টুকরো করে পায়ে দলে চলে এসেছিলাম । আমার একটা প্রশ্ন সবসময়ই মাথায় ঘুরতো ওনার বাবা-কাকাও জ্যোতিষ থাকা সত্বেও কেনো কেশবদার পঙ্গুত্ব রদ করা গেলোনা ? এবং কেশবদার অন্য ভাইদের বখে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলেননা । নিজের ক্ষেত্রে যেটা রদ করতে পারলেন না তিনি অন্যদের সাফল্য কি করে আনবেন ?

১৯৯০ সাল নাগাদ রাশিয়ার লেলিনকানে বীভৎস ভূমিকম্পের ( প্রায় ৬০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল ) পর ৯ আমার কিছু ছাত্রবন্ধু ও বন্ধুকে নিয়ে আমাদের পাড়ার নাম করা জ্যোতিষ রঞ্জিত চ্যটার্জীর কাছে গিয়েছিলাম ওনাকে একটু ইয়ে .........করব বলে । উনি তখন পুরানো বি ডি ও অফিসের নিচে বসতেন । অপু , সুজিত , রতন , সঞ্জীব , অতনু অনেকে ঐ দলে ছিল ।উনি ভাবলেন অনেকগুলি মুরগী পাওয়া গেছে । আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি কি বলতে পারেন ? উনি বললেন তুমি সিনেমা হলে গেলে টিকিট পাবে কিনা , টিকিট পেলে ও সিনেমা দেখতে পাবে কিনা তাও বলে দিতে পারেন ।আমাদের বন্ধু রতনের বাবা মা অনেদিন আগেই মারা গিয়েছিল । আমি রতনকে ওর হাত দেখাতে বলি ।রতন ওর হাত দেখালে , আমি বললাম দেখুনতো ওর বাবার শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে , ওর কি করা উচিত । উনি রতনের জন্ম তারিখ জিজ্ঞাসা করলেন এবং কিছুক্ষণ রতনের হাত দেখে বললেন ওর রাহুর অবস্থা খুব ভাল নেই , তবে পলা না কি একটা রত্ন ধারণ করলে ঠিক হয়ে যাবে, ওর বাবার শরীর ও ঠিক হয়ে যাবে। সবাই মিটমিট করে হাসছে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি দেখে বললেন ? উনি বললেন মানুষের জন্ম তারিখ সব কিছুর নির্ধারক ।সেই সময় রাশিয়ার লেলিনকানে ভূমিকম্পে প্রায় ৬০০০০ লোক মারা গিয়েছিল । আমি ওনাকে বললাম আচ্ছা রাশিয়ার ৬০০০০ মৃত ব্যাক্তির মধ্যে শিশু ,বালক, কিশোর , যুবা, মাঝবয়সী , বৃদ্ধ সহ সমস্ত বয়সের নারী পুরুষ মারা গেছে ।সবার জন্মতো একসাথে হয়নি । একথা শুনে উনি খুব রেগে গ্যালেন ,বললেন এগুলি বিভিন্ন দেশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে । আমি বললাম সব যদি পরিবেশের ওপর নির্ভর করে তবে আপনার কাছে আসবো কেন ? তখন উনি বুঝতে পেরেছেন আমাদের আসার উদ্দেশ্য এবং আমাদের যা তা বলতে শুরু করলেন । আমরা হো হো করে হাসতে হাসতে ওনাকে জানালাম রতনের বাবা মা অনেকদিন আগে মারা গেছে। ওনাকে ভন্ড জোচ্চর বুজরুক শঠ ও অন্যান্য উপাধিতে ভূষিত করে চলে এলাম । এবারো সব জ্যোতিষদের প্রশ্ন করলে হয় , আপনাদের বিচারের ক্ষেত্রে যদি জাতকের জন্ম সময় ও রাশি খুব গুরুত্বপূর্ণ তাহলে করোনায় যে দু লক্ষ লোক এখনো পর্যন্ত মারা গেছে তারাতো সবাই এক সময়ে এক দেশে জন্মায়নি তারা সব একসাথে মারা যাচ্ছে কি করে? বা ১৯৯৬ সালে সুনামীতে প্রায় চার লক্ষ লোক একসাথে মারা গেছে তারা একসাথে মারা গেল কেনো ?

আমার গল্প দুটি বলার কারণ এইসব ভাগ্যের কারবারীদের হাতে কত মানুষ সর্বসান্ত হচ্ছে ভাবা যায় না । ক্লাশে ছেলেদের মধ্যে কবজ মাদুলি কানে দুল হাতে মন্ত্রপুত বালা পরার ধুম বেড়েছে । টি ভি খুললেই ধনলক্ষী যন্ত্র হনুমান চল্লিশা , পাওয়ার ব্রেসলেট , ............ সহ অনেক যন্ত্রের বিজ্ঞাপনে দুর্বল মানুষ সব হারাচ্ছে । টি ভি র কয়েকটি চ্যানেলে সারা দিন ধরে জ্যোতিষদের প্রোগ্রাম , আর সেখানে মনু, খনা, তারাসিদ্ধ, মিহিরাচার্য , শাস্ত্রীজীরা সবসময় আছেনই । কাগজ খুললেই এদের বিজ্ঞাপন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে ।ধনতন্ত্রের এবং সামন্ততন্ত্রের জাতাকলে মানুষের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে আর মানুষ দুর্বল থেকে দুর্বল হচ্ছে , পরিবেশ দূষণের জন্য রোগ ব্যাধি বাড়ছে , অসহায় অশিক্ষিত নিরক্ষর এবং ডিগ্রীপ্রাপ্ত অশিক্ষিত মানুষ এদের কাছে যাচ্ছে আর সর্বসান্ত হচ্ছে । রামমোহন – বিদ্যাসাগরের এবং দীর্ঘদিন বামপন্থী প্রভাবিত রাজ্য বাংলাও কুসংস্কারের দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়ছে । ৩৪ বছর বামপন্থীরা ক্ষমতায় থেকেও বিজ্ঞান আন্দোলন ও কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারেননি শুধু স্টাটাস্কো বজায় রেখে শাসন অপশাসন করে গেছে এবং তার ফল এখন পাচ্ছে । নামমাত্র বিজ্ঞান আন্দোলন ও সব কিছুকে পার্টীর পতাকার নীচে আনতে গিয়ে বাংলার বিজ্ঞান আন্দোলনকেও শেষ করে দিয়েছেন । মানুষও বর্তমানের থেকে বেশি করে ভবিষ্যতের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছে ।।

এসবের প্রতিবাদ করলেই গোবিন্দ পানেসর ,নরেন্দ্র দাভেলকর , কালবুর্গী , গৌরি লঙ্কেশ , খলিল মাহমুদদের মত যুক্তিবাদী মানুষদের প্রকাশ্য স্থানে মরতে হয় হিন্দু মুসলিম মৌলবাদীদের গুলিতে । বা ঢাকার রাজপথে অভিজিত রায় – নীলয় –দীপন – ওয়াসিকুর –রাজীব মুসলিম মৌলবাদীদের গুলিতে মরতে হয় । এতে বোঝা যায় সামন্ত ও ধনতন্ত্রের প্রভুরা বিরোধীতা পছন্দ করেনা । যাদের বাঁচিয়ে রাখে এইসব অপবিজ্ঞান কুসংস্কার ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিরা । সব ধর্মের মৌলবাদীরা একই রকম হিংস্র জন্তুর মত , বিরোধিতা করলেই নখ দাত নিয়ে ছিড়ে ফেলতে চায় । ধনতন্ত্র চায় এসবের প্রকাশ এবং এসবকে প্রমোট করে এবং সঙ্গে ধর্মকেও প্রমোট করে । ধর্মের সুড়সুড়িতে মানুষের যে আবেগ তৈরি হয় তা ভোট বাক্সে চালান করে সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয় ।

আমাদের দেশে বেদ ও উপনিষদের কর্ম ও জ্ঞানের দার্শনিক বলিষ্ঠতা হারিয়ে যেদিন থেকে গণমানসে গ্রীক নিয়তিবাদ গীতায় শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে এদেশে চেপে বসল , সেদিন থেকে এই জ্যোতিষবিদ্যা প্রসার লাভ করল দ্রুত গতিতে । নিয়তি বা অদৃষ্টবাদের দার্শনিক অভিজ্ঞান ভারতীয় বিদ্যায় নতুন ধারার সঞ্চার করেছিল, যা পরিপূর্ণ রূপ পেল গীতায় । যেখনে মানুষের সমগ্র জীবনই যেন পূর্বনির্ধারিত নিয়তির নির্দেশে পরিচালিত হয়। সমগ্র ধর্মগ্রন্থে পুরানে শুধু ব্রাহ্মণকে ভক্তি করো দান করো পূজা করো , দেবদেবী আর রাজা্র পূজা , শূদ্রদের জন্য শুধু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়- বৈশ্যদের সেবা অর্থাৎ উচ্চবর্ণের মানুষের জন্য শ্রমদান এবং সেখানেও নিষ্কাম কর্ম করো অর্থাৎ

--- গীতার সেই অমোঘ বাণী --- মা ফলেষু কদাচন । শুধু সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যদের সম্পদ বাড়াও এবং শূদ্ররা সঞ্চয় করবেনা একথাও বলা হল । এবং সবই শূদ্রদের পূর্বজন্মের কাজের ফল ও এ জন্মে ভাল সেবা করলে পরজন্মে উন্নত জীবনের লোভও দেখানো হলো । আর সব কিছুই যেন নিয়তি নির্দিষ্ট । মানুষের প্রচেষ্টা বা পরিশ্রমজাত ফলাফল ছিল মানুষের নিয়ন্ত্রণহীণ ও পূর্বনির্ধারিত ।মানুষের ব্যাক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের প্রচেষ্টা, উদ্যম বা অনুসন্ধিৎসার কোন ভূমিকা ছিলনা । ফলে উদ্যমহীনতা ও অণ্বেষণহীনতায় সংক্রামিত ভারতীয়দের জীবনে শুধু হতাশা আর পরমাত্মায় বিলীনের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছু ছিলনা । সেটা বোঝা যায় সুদূর উত্তর গোলার্ধ থেকে এসে ক্যাপ্টেন কুক দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করল এবং দখল করে নিল , আর ভারতীয়রা দেশের বাইরে বেরিয়ে কি আছে দেখল না কারণ কালাপানি পেরনো নিষেধ আছে ধর্মগ্রন্থে । ভারতের উর্বর জমি ও একটি কারণ এই নিস্পৃহতার । একসময় সমগ্র ইউরোপকেও গ্রীকদেশীয় অদৃষ্টবাদ গ্রাস করেছিল ।--------- যীশুখ্রীস্ট এই অদৃষ্টবাদের মূলে আঘাত করে ইউরোপের মানুষের জীবনবোধে প্রথম পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং মধ্যযুগের উইচ হান্টিং পেরিয়ে শিল্পবিপ্লব তড়তড় করে এগিয়ে চলে এবং নিকষ অন্ধকার কাটিয়ে আধুনীক যুগে ।ভারতে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল---- চার্বাকদের দ্বারা , কিন্তু প্রবল প্রতাপ ব্রাহ্মণ্যবাদ এরা চার্বাকদের ধনেপ্রাণে মেরে ফেলে । বেদ বিরোধী ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈনরাও এর বিরুদ্ধে লড়াই দিয়েছিলেন অনেকদিন কিন্তু বুদ্ধের পরবর্তীকালে সেইরকম কোন মহামানব বা নেতৃত্ব না আসার ফলে এই লড়াই থেমে যায় । একদিকে দুঃখ, দুর্দশা বিপরীতে শ্রমহীন পরজীবীদের বিলাসী জীবন সবই ছিল নিয়তি নির্দিষ্ট ।সামগ্রিকভাবে এই নিয়তিবাদী দর্শণ বিজ্ঞানের ভবিষ্যত পরিপন্থী । ধর্মও তাই ---- ধর্মে সবই বিশ্বাস বা ইনাম করতে হবে ঈশ্বর বা আল্লাহকে কিন্তু বিজ্ঞান সব যুক্তির আলোকে বিচার করে --- এটাকে অপসারণ করতেই এল --- বিশ্বাসে মিলায় হরি তর্কে বহুদূর বলে মানুষের জন্মগত কৌতূহল ও অনুসন্ধিতসাকেই বাতিল করে দেওয়া হলো , তার ফলেই পিছিয়ে পড়লো ভারতীয় সমাজ । বৌদ্ধযুগেই প্রাচীন ভারতের সব থেকে উন্নতি হয়েছিল , এটা রবীন্দ্রনাথও পরিচয় গ্রন্থে বলে গেছেন । এক অদ্ভুত বিষন্নতা নিস্পৃহ নির্লিপ্ত অলস জীবনবোধে আচ্ছন্ন ভারতীয় সমাজ । ব্রিটিশদের হাত ধরে পাশ্চাত্য শিক্ষা না এলে বিশ্বকে জানার যৎসামান্য উৎসাহই সৃষ্টি হতোনা । ভারতীয় রাজশক্তি নিজের প্রয়োজনেই টিকে থাকতে এই অপবিজ্ঞানকে লালন পালন করেছে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে । যদিও সেকালেই গণৎকারকে রাজার কেটে ফেলার গল্প তৈরি হয়েছিল ।এক রাজার রাজসভার জ্যোতিষী একদিন সবার হাত দেখছে এবং তাদের আয়ু বলে দিচ্ছে , এভাবে রাজার হাত দেখে রাজাকে বললেন , মহারাজ আপনার আয়ু আর বেশী দিন নেই । রাজা খুব চিন্তায় পড়ে গেল , ঠিক সেই সময় সেনাপতি এসে রাজার এমন চিন্তার কারণ জানতে চাইলো , রাজা তাকে জ্যোতিষীর কথা বললেন । তৎক্ষণাৎ সেনাপতি জ্যোতিষীকে জিজ্ঞেস করলেন , গণৎকার আপনার আয়ু কতোদিন ? গণৎকার বললেন আমার আয়ু এখনো অনেকদিন । সেনাপতি খাপ থেকে তলোয়ার বার কর সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষীর মাথা কেটে দিল । এবং রাজাকে বললেন মহারাজ এইসব জ্যোতিষ বিদ্যা সব বুজরুকিতে ভরা , এগুলিতে বিশ্বাস করলেই ঠকবেন ।

আদিম মানুষকে সব থেকে বেশী প্রভাবিত করেছিল আকাশ । একদিকে তার অসীম দান, অপর দিকে বজ্রপাত ঝড়ঝঞ্ঝা তুষারপাত বন্যা খরা সাইক্লোন সবই আকাশ থেকে সৃষ্টি ।সুতারাং মানুষের কল্পনায় জিবনে বিপর্যয় বা সৌভাগ্যর রহস্যটা লুকিয়ে আছে দীপ্তিমান সূর্য আর নক্ষত্রখচিত বিশাল আকাশের অপার রহস্যে । প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াসের শ্রেষ্টতম স্রোতের সাথে ভাগ্য গণনার বিপরীতমুখী উদ্যমহীন নিয়তিবাদী ধারাটিও মিলে মিশে একাকার হয়েছিল অনুসন্ধানের সেই অনগ্রসর স্তরে ।প্রাচীন মানুষের কাছে টেলিস্কোপ বা ঐ ধরণের কোন যন্ত্র ছিল না। ফলে জ্যোতিষবিদ্যা কয়েক হাজার বছর ধরে শ্রেষ্ঠ মেধা, অসাধারণ মননশীল চিন্তানায়ক মনীষীদের অনুসন্ধানের এবং সস্নেহ প্রশ্রয়ে মানুষের বিশ্বাসের গভীরে শিকড় ছড়াতে পেরেছিল । চার্বাক ঋষিরা , টলেমি , গ্যলিলিও , কোপার্নিকাস , কেপলার জিওনার্দো ব্রুনো এরা এই বিশ্বাসের গোড়ায় আঘত হানে ।যদিও ধর্মভীরু টলেমি পরে মত পালটে ফেলেছিলেন । ভারতে চার্বাক গোষ্ঠী প্রথম এই অদৃষ্টবাদের গোড়ায় আঘাত হানে ।গ্যলিলিওকে কারাগারে , জিওনার্দো ব্রুনোকে জ্যন্ত পুড়িয়ে আর চার্বাকদের হত্যা করে সত্যের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল ।ক্রুশে বিদ্ধ জিওনার্দো ব্রুনোর সেই উক্তি আমাকে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারলে বা না মারলে ও পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরবে ।বিজ্ঞান পড়ে বিজ্ঞান মনস্ক হওয়া আর ডিগ্রী অর্জন করার জন্য পড়ার মধ্যে আকাশ –পাতাল ফারাক । সুতারাং আমাদের দেশে ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী , চিকিতসক, ইঞ্জিনিয়ার আইনজীবী শিক্ষক অধ্যাপকেরা মনু খনা শ্রীভৃগুদের কাছে কবজ মাদুলি আংটির জন্য লাইন দেবে এতে আর আশ্চর্য কি !

জ্যোতিষ বিদ্যার ভিত্তি জ্যোতিষবিদ্যা এবং জ্যোর্তিবিদ্যা এক নয় ।


আমরা টেলিস্কোপ ও উপগ্রহের ছবি থেকে জানি সূর্যকেন্দ্রীক এই সৌরমন্ডল ।মহাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি আছে । আমাদের একটা গ্যালাক্সিতে কোটী কোটী নক্ষত্র আছে । প্রতিটি গ্যালাক্সি গতিশীল ।কিন্তু জ্যোতিষে পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের বর্ণণা আছে ।নব গ্রহে সূর্য চন্দ্র বৃহস্পতি , মঙ্গল , শুক্র , শনি , বুধ রাহু কেতু ইত্যাদি গ্রহ , আজকের দিনে মানুষ মহাকাশে পৌঁছনোর পরে ভাবতে পারেন সূর্য-চন্দ্র-রাহু-কেতু গ্রহের মধ্যে পড়ে ? আরো নতুন কতো গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে এবং এখনো অনাবিষ্কৃত অনেক গ্রহ হয়তো আছে । আর পৃথিবী কেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা এখনো মেনে নিতে হবে ? ।আমাদের বিজ্ঞানী ডাক্তার শিক্ষক অধ্যাপক মহাশয়েরা একবারও এগুলি ভাবেন না যখন পাথর আংটি কবজ মাদুলি ধারণ করেন ।সূর্য পরিক্রমারত পৃথিবীর একটুকরো আকাশকে ক্রান্তিবলয় ধরা হয় । এই জ্যোতিষশাস্ত্রে পৃথিবী স্থির ও পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ রত জ্যোতিষ শাস্ত্রে নির্দেশিত গ্রহরাও ভিন্ন ভিন্ন গতিতে এই বলয় ধরে বহমান । কোটী কোটী নক্ষত্রের মধ্যে ক্রান্তিবলয়ের ওপর মাত্র ২৭ টি নক্ষত্রকে বেছে নেওয়া হয়েছে , এর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়নি । এরা হল অশ্বিনী, কৃত্তিকা রোহিণী, পুনর্বসু পুষ্যা অশ্লেষা মূলা পূর্বষাঢ়া অনুরাধা চিত্রা ভরণী মৃগশিরা আর্দ্রা মঘা পূর্ব ফাল্গুনি , উত্তর ফাল্গুনী , হস্ত্য, স্বাতী , বিশাখা , অনুরাধা , জ্যাষ্ঠা , শ্রাবণা , ধনিষ্ঠা , শতভিষা , পূর্বভাদ্রপদ , উত্তর ভাদ্রপদ , রেবতী ইত্যাদি । । নিরক্ষীয় বৃত্তের ৩৬০ ডিগ্রীকে ১২টি ভাগ করা হয়েছে , এক একটি ভাগ ৩৬০/১২ বা ৩০ ডিগ্রী , যে ছবি হরস্কোপ বা ঠিকুজিতে থাকে । এই ১২টি ভাগের এক একটিকে নক্ষত্রদের অবস্থানের জন্য এতে একটি করে অবয়ব তৈরি হয় , এগুলিকেই এক একটি রাশি ধরা হয়েছে ।রাশিচক্রের পথে ভিন্ন গতিতে আবর্তমান নয়টি গ্রহ ।এক একটি রাশিতে যে নক্ষত্রগুলির অবস্থান তাদের বিন্যাস বৈশিষ্ট্যে মানুষের কল্পনা জন্তু বা অবয়বের ছায়া ফুটে উঠত তাদের দোষগুণের বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা হয় । এইরাশিগুলি হলো যথাক্রমে সিংহ , বৃষ , কর্কট , মেষ , কন্যা , মিথুন ইত্যাদি ইত্যাদি ------ । এই শাস্ত্রে জন্ম সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ , মানুষের জন্ম মুহূর্তে গ্রহ নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে ।জাতকের জন্মের সময় যে নক্ষত্রটি পুব আকাশে থাকে সেটি হয় জন্মলগ্ন এবং সে মুহূর্তে যে রাশিতে চন্দ্র অবস্থান করে সেটি হল জন্মরাশি । জ্যোতিষবিদরা বলেন প্রত্যেক গ্রহ নক্ষত্রের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও একটি বিশেষ ধরণের বিকিরণ ক্ষমতা আছে, এই বিকিরণ প্রভাব বিস্তার করে মানুষের জীবনে । সংক্ষেপে আমি জ্যোতিষবিদ্যা সম্পর্কে বললাম।

এই তত্ত্বের অসাড়তাগুলি নিচের অল্প কয়েকটি প্রশ্নে বিদ্যমান

১। মহাকাশের কোটী কোটী নক্ষত্রের মধ্যে কেন মাত্র ২৭ টিকে ধরা হবে ? আমেরিকান বিজ্ঞানী হাবেলের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটী গ্যালাক্সি আছে , এবং প্রতিটি গ্যালাক্সিতে কোটি কোটি নক্ষত্র আছে । ব্রহ্মাণ্ড এখন প্রতিদিন বাড়ছে এবং এর উপর গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেলো । । তাহলে মানুষের ভাগ্য গণনার ক্ষেত্রে শুধু ২৭ টি নক্ষত্রকে ধরা হবে কেনো ?

( এখনো সেই অবৈজ্ঞানিক পৃথিবী কেন্দ্রীক বিশ্ব কল্পনা করে নিয়তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত জ্যোতিষশাস্ত্র এই সূর্য কেন্দ্রীক সৌরমন্ডলের মহাকাশগামী মানুষ কিভাবে মেনে নেয় ? প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলি সব এই পৃথিবী কেন্দ্রীক ব্রহ্মাণ্ডই মেনে চলে । )

২। আমরা জানি মহাকাশের কোনো কোনো নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসতে ৪/৫ বছর লাগে বা তার থেকে বেশীও লাগতে পারে আবার আরো কোনো দূরবর্তী নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে পৌছায়ইনা আবার মৃত নক্ষত্রের আলোও অনেকদিন পর্যন্ত দেখা যায় । তাহলে জাতকের জন্ম মুহূর্তে যে নক্ষত্র দেখা যায় তা থেকে অনেক আগেই বিকিরণ শুরু হয়েছে , তাহলে সেই নক্ষত্রকে জ্যোতিষে জাতকের জন্মরাশি ধরা হবে কেন ? যে নক্ষত্র মারা গেছে অথচ তার আলো জাতকের জন্ম মুহূর্তে দেখা গেছে তাকে জাতকের জন্মরাশি কি ধরা হবে ?

৩। নবগ্রহে সূর্য চন্দ্রকে গ্রহ বা রাহু কেতু ইত্যাদি গ্রহ – আপনি আজকের দিনে বিশ্বাস করেন কি ? অথচ ইউরেনাস নেপচুন প্লুটো ভল্ক্যান প্রভৃতি গ্রহকে হিসাবে ধরা হবে না কেন ?

৪। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে একসাথে বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় । প্রত্যকের জন্মরাশি এক নয় , একসাথে জন্ম না হওয়া সত্বেও একসাথে মৃত্যু হয় কেন? সুনামিতে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে , তারা সবাই রকই দিনে জন্মগ্রহণ করেনি , তা সত্বেও সবাই একসাথে মরলো কেনো ?

৫) পৃথিবী কেন্দ্রীক টলেমির বর্ণিত বিশ্ব ব্যবস্থাই এখনো জ্যোতিষের মূল ভিত্তি , পৃথিবীকে স্থির ধরেই সব হিসাব করা হয় । তাহলে আজকের দিনে ওনারা যা বলেন তা ডিগ্রীধারী পণ্ডিতেরা কি করে বিশ্বাস করেন ? গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ আবিষ্কারে প্রাচীন বিশ্বাস ভুত ভগবান শয়তান আঘাতের ভয়ে প্রত্যাঘাত শুরু করে এবং গ্যালিলিও কারারূদ্ধ হয়ে মরে । জিওনার্দো ব্রুনোকে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থার তত্ব জনসমক্ষে আনার জন্য জ্যান্ত পুড়িয়ে মরতে হয় । দাভালকার অভিজিত মানুষদেরতো জীবন বলী দিতেই হবে ।

৬) জ্যোতিষেরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা বলে দাবী করেন , ওনারা বিজ্ঞাপণ দিয়ে খরিদ্দারের জন্য হাপিত্যেশ করে কেনো ? ভবিষ্যৎ খরিদ্দারতো জানেনই সরাসরি তাদের সাথে যোগাযোগ করেননা কেন ?

আরো অনেক যুক্তির অবতারণা করা যায় । আমার খারাপ লাগে শুধু মুনাফার জন্য প্রচার মাধ্যম জ্যোতিষবিদ্যার গুন , পাথর , কবচ মাদুলি এদের আধুনিক রূপ পাওয়ার ব্রেসলেট হনুমান চাল্লিশা ধনলক্ষী যন্ত্রের প্রচার করে সমগ্র সমাজকে নিয়তির দাস করে চলেছে এবং বিভ্রান্ত করছে । আপনি একটি টি ভি চ্যানেলের জ্যোতিষের সাথে কথা বলতে চান পারবেননা । ওখানে ওনাদের সব সাজানো নাটক চলে । জ্যোতিষদের নামে সামন্তপ্রভু আর ধনতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ঠ দুর্বল মানুষকে ভয় দেখিয়ে রত্ন ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ছে আর সাধারণ দুর্বল মানুষ সর্বসান্ত হচ্ছে ।জুন মালিয়া শ্রীলেখা অভিষেক প্রভৃতি হাবিজাবি শিল্পীরা এইসব ঠগেদের বিজ্ঞাপন দিতে পারে , তা বলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সমাজ সচেতক ব্যক্তিরা ঠকানোর বিজ্ঞাপন দেবে ? আসলে ভোগবাদে এই সমাজে সবাই টাকায় বিক্রী হয় ।

গোবিন্দ পানেসর দাভালকার অভিজিৎ রায় নীলয় দীপন রাজীব ওয়াসিকুরদের মেরে যুক্তিবাদী আন্দোলন শেষ হবে না । সামন্ত্রতন্ত্রের এবং ধনতন্ত্রের কুফল মানুষ ভোগ করছে বহুকাল ধরে । যুক্তিবাদী মানুষদের একত্র হয়ে জ্যোতিষদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর সময় এসেছে । হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা কুসংস্কার মানুষের মনে গেঁথে আছে । মেটারিয়ালিটি শিল্পায়নের ফলে দ্রুত পরিবর্তন হয় কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া স্পিরিট দ্রুত পরিবর্তন হয় না । জানি এর উৎপাটন হওয়া এত সোজা নয় এত তাড়াতাড়ি। আশাবাদী হতে ক্ষতি কি ?

লিখেছেন:শম্ভু মজুমদার
ছবি:শম্ভুনাথ মজুমদার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ