এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শাড়ি

'নারীর পোশাক শাড়ি' - এইটা কে বা কারা আইন করে , নীতিমালা করে নির্ধারণ করলো !! ?? শাড়ির মতো ছয় গজের এমন বিশাল একটা কাপড়কে সায়াব্লাউজ সহকারে পরিধান করার পর একজন মানুষ কি সচ্ছন্দে চলাফেরা বা কাজ করতে পারে , বুঝি না !! ??

শাড়িকে যদি নারীর পোশাক হিসেবে নির্ধারণ করা হবে - তাহলে পুরুষ কেনো চার গজের ধুতি ও ফতুয়া পড়বেনা ?? পুরুষ ঐতিহ্যময় পোশাক ধুতিফতুয়া ত্যাগ করে যদি ভিন্ন কোনো আরামদায়ক ও কাজে সাহায্যকারী পোশাক পরতে পারে - তবে নারী কেনো শাড়ি ত্যাগ করে অন্য কোনো আরামদায়ক ও কাজে সাহায্যকারী পোশাককে বেছে নেবেনা !! ??

না , ভারতবর্ষের বাঙালীর ঐতিহ্যময় পোশাক শাড়িধূতিকে আমি অসম্মান করছি না । বরং আমি চাই ভারতবর্ষের বাঙালীর ঐতিহ্য টিকে থাকুক । তবে সেইসব ঐতিহ্যকে আমি টিকিয়ে রাখতে চাই যা যৌক্তিক , বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থ্যাৎ বিজ্ঞানের সুত্র দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় ও যা সময় ও যুগোপযোগী ইত্যাদি ; বাকিটা ঐতিহ্য হিসেবে জাদুঘরে সংগ্রহ থাকুক ।

সুতরাং ভারতবর্ষের বাঙালীর ঐতিহ্যময় পোশাকের মধ্যে যেইসব পোশাকগুলো কাজ ও চলাফেরার জন্য পরতে সাবলীল ও আরামদায়ক - আমার মতে সেইসব পোশাকই ভারতবর্ষের বাঙালী নারীপুরুষহিজড়াদের কাজ করার সময় ও ব্যস্ততার সময় পরা উচিত - যাতে তারা সাচ্ছন্দে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারে ।

আর যেইসব পোশাক - চলাফেরা ও কাজের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে কিন্তু আরামদায়ক অথচ দেখতে খুবই সুন্দর সেইসব ঐতিহ্যময় চমৎকার দৃষ্টিনন্দন পোশাকগুলো আমরা ভারতবর্ষের বাঙালিরা অবশ্যই পরবো তবে কোনো আনন্দদায়ক অবসর সময়ে , কোন উৎসবে , পার্বনে , বন্ধুদের আনন্দ মেলায় ইত্যাদি বিনোদনমূলক সময়ে -- কিন্তু কাজ বা ব্যস্ততার মাঝে না ।

এই অবসরে বলে রাখি - আমার কাছে খুব অবাক লাগে যে , স্বার্থপরের মতো ভারতবর্ষের বাঙালি পুরুষরা কেনো ঐতিহ্যময় পোশাক ধুতিফতুয়া ও খাটো আকারের পাঞ্জাবি পরিধান করা বাদ দিয়ে ইউরোপের পুরুষদের পোশাককেই তাদের একমাত্র পোশাক বলে মেনে নিলো !! ?? আর নারী কেনো সেইটা পারলো না !! ??

নাকি , বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একমাত্র নারীরই দায়িত্ব হলো নিজেদের ঐতিহ্যকে ধারন ও লালনপালন করা ? এইক্ষেত্রে পুরষের কোনো দায়িত্বই নাই ? ঐতিহ্য রক্ষা করার দায়িত্ব যদি থাকে তবে পুরুষনারীহিজড়া সবারই থাকবে - আর , না থাকলে , কারোরই নাই । নারীর উপর এই মহান দায়িত্ব কে বা কারা চাপিয়ে দিলো ? নাকি , নারী নিজেই স্বইচ্ছায় বেছে নিয়েছে ? কোনটা ? 

পুরুষ তার ইচ্ছামত আরামদায়ক ও সাবলীল পোশাক পরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারে - আর যতো ঐতিহ্য ও নিয়মনীতি সব পালন করবে নারী !! ?? কেনো ? নারীকে এই দাসখত দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে কে বা কারা আদেশ দিলো !! ?? নারীর কি এমন ঠিকা পড়ছে পুরুষতন্ত্রের চাপানো পোশাক ঘাড়ের উপর নিয়ে ঐতিহ্য রক্ষা করার !! ??

পুরুষ যদি ঐতিহ্যকে যাদুঘরে পাঠাতে পারে , তবে নারীও পারে । পারবেনা কেনো ? নারীকে পারতেই হবে সকল বাঁধাবিপত্তি পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য , আত্মনীর্ভরশীল সুঠাম মানুষ হবার/হওয়ার জন্য । তবে , ব্যাপারটা পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে করতে হবে তা বলছি না ; নারীকে তা করতে হবে সাচ্ছন্দে চলাফেরা করার জন্য ।

প্রতিটা মানুষ অবশ্যই নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরবে তা নিয়ে আমার দ্বিমত নাই , দ্বিমত থাকার প্রশ্নই ওঠেনা । কারণ মানুষ কি করবে , না করবে - সেইটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা , সিদ্ধান্ত ও অধিকার । কারো ব্যক্তিগত চাওয়া বা সিদ্ধান্তে বাঁধা প্রদান করা নিশ্চয়ই যায় না । কিন্তু পুরষতন্ত্র শাসিত সমাজ নির্লজ্জের মতো সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে তা করে যাচ্ছে । ধিক !!

কিন্তু প্রশ্ন জাগে - নারী যদি শাড়ির পরিবর্তে ভিন্ন কোনো পোশাক পরে তবে - একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও সেই সমাজের পুরুষনারীরা কেনো নারীকে চোখ রাঙাবে , টিটকারি দেবে , অযথা হয়রানি করবে ?? কেনো , পুরুষের চাপিয়ে দেয়া পোশাক পরতে বাধ্য করবে ? কেনো ?

মুসলিমরা যেমন নারীর উপর বোরখা চাপিয়ে দিচ্ছে তেমনি - ভারতবর্ষের বেশীরভাগ লোক ও বৃহত্তর বাঙলাদেশের সমস্ত পুরুষতান্ত্রিক নারীপুরুষ ও সমাজ কি নারীর উপর শাড়ি চাপিয়ে দিচ্ছেনা ?? বোরখা না পরলে নারীকে যেমন গঞ্জনা , অপমান সইতে হচ্ছে তেমনি শাড়ি না পরলেও - বয়স্ক ও বিবাহিত নারীদের গঞ্জনা , অপমান ইত্যাদি সহ্য করতে হচ্ছে ।

কিন্তু কেনো ? নারীর উপরই কেনো একগাদা পোশাক চাপিয়ে দেয়া হবে !! ?? এইক্ষেত্রে অবশ্য ভারতবর্ষের বেশীরভাগ মুসলিম ও বৃহত্তর বাঙলাদেশের সমস্ত মুসলিম পুরুষতান্ত্রিক নারীপুরুষ ও সমাজ হচ্ছে - সেরের উপর সোয়াসের ! এরা আরো এককাঠি উপরে ; এরা নারীর উপর শাড়ি ও বোরখা - দুইটাই চাপিয়ে দিয়েছে । আ মরন !!

কোনো মানুষ যদি চায় সে পোশাক পরবে - পরবে , যদি সে পোশাক পরতে না চায় তবে পোশাক পরবেনা - এইটা মানুষের  ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত , স্বাধীনতা ও অধিকার । - এইটাতে সমাজ ও রাষ্ট্র কেনো নারীকে বাধ্য করতে চোখ রাঙানি দেবে , অপমান করবে , অসম্মান করবে , জেলে পুরবে/পোরবে , শাস্তি দেবে ?? কেনো ? 

নগ্ন বা অর্ধনগ্নতা যদি কোনো মানুষ পছন্দ নাকরে , তবে নাকরতেই পারে , সেইটা তারও ব্যক্তিগত পছন্দ , সিদ্ধান্ত , স্বাধীনতা ও অধিকার ; তাই বলে কেউ ব্যক্তিগতভাবে নগ্ন বা অর্ধনগ্নতা পছন্দ করছেনা বলে - সে , অন্য মানুষের উপর নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দিয়ে অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করবে কেনো !! ?? কোন অধিকারে ?

যে বা যারা নগ্ন বা অর্ধনগ্নতা পছন্দ করেনা সে বা তারা নগ্ন বা অর্ধনগ্ন মানুষের সাথে মিশতে , চলাফেরা করতে না চাইলে করবে না । সে বা তারা , তাদের চোখ দিয়ে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন মানুষের দিকে তাকাবেনা , অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে । কিন্তু তাই বলে তাদের নিজেদের পছন্দ হচ্ছেনা বিধায় অন্যরা নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হতে পারবেনা - এইটা কোথায় , কোন জন্মে দাসখত দিয়ে রেখেছে মানুষ !! ??

কেনো এইরম নগ্নতা বিরোধী স্বাধীনতা হরনকারী অদ্ভুত অযৌক্তিক আইন ও নিয়ম তৈরী করে মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হবে ?? কি এমন লাভ এতে ? কেউ নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হলে অন্যদেরই বা কি এমন ক্ষতি হচ্ছে !! ?? যত্তসব মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনায় ডুবে আছে সবাই !! ধেত্তরি !

এই যুগের পুরুষরা তো প্যান্ট শার্ট কোট ব্লেজার ইত্যাদি পোশাককে তাদের অফিসিয়াল পোশাক ও ভদ্রজনিত পোশাক বলে বিবেচনা করে থাকে তাই প্যান্ট শার্ট কোট ব্লেজার ইত্যাদি পোশাককে তাদের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছে । তাহলে নারীরা কেনো তাদের পোশাক হিসেবে প্যান্ট শার্ট কোট ব্লেজার ইত্যাদি পোশাককে তাদের পোশাক হিসেবে বেছে নিচ্ছেনা ?

পুরুষরা যদি ধুতিফতুয়া না পরে পার পেয়ে যেতে পারে ; এমনকি ভদ্রলোক ও আধুনিক বলে প্রশংসা কুড়াতে পারে - তবে , নারীকেই কেনো সেই শাড়িতেই আটকে থাকতে হবে !! ?? নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করার দায়িত্ব একমাত্র শুধু নারীর ?? পুরুষের কোনো দায়িত্ব নাই নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখার ?? কী , নাই ??

কই , নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তো কোনো সমস্যা হয় নাই ধূতি-পাঞ্জাবী পরে নোবেল পুরস্কার নিতে ! তাহলে - ধূতি-পাঞ্জাবী পরতে অন্য বাঙালীদের এতো সংকোচ কিসের ? না কি তারা নোবেল জয়ী বাঙালীর চেয়ে বেশী জ্ঞানী-গুনী ও সম্মানিত ? নিজের সংস্কৃতির চর্চা করতে বিঙালীর এতো হীনমন্যতা কেনো ?? আশ্চর্য !!

পুরুষরা যদি ইংরেজদের পোশাককে নিজেদের শরীরে চাপিয়ে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ত্যাগ করতে পারে তবে নারীর এমন কোন বালের ঠ্যাকা পরেছে নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রেখে সারাজীবন মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করে যাওয়ার !! ?? তাছাড়া - শাড়ি কেনো হবে একমাত্র নারীর পোশাক ? ! আর কোনো আরামদায়ক পোশাক নাই নারীর জন্য ?

এছাড়াও আরেকটা কথা এই অবকাশে বলে রাখি - চাইলে , পুরুষরাও কেনো শাড়ি পরতে পারবে না ? কোনো কোনো ইতিবাচক মানসিকতার ব্যতিক্রম পুরুষরা যদি শাড়ি পরেই ফেলে তবে সামাজিক বিধিনিষেধ ও অপমানের অন্ত থাকে না !! আশ্চর্য , লোকেরা সবকিছুকেই একটা কাঠামোতে ফেলে দেয় কেনো !! ??

আমরা কেনো , আরো মুক্তমনের , আরো উদার হতে পারি না !! ?? কি অদ্ভুত কুপমুন্ডক আমাদের মানসিকতা !! এইখানে একটা গোপন ইচ্ছার কথা বলে ফেলির লোভ সামলাতে পারছি না - জানেন , শাড়ি সহ নারীদের বিভিন্ন পোশাক আমার খুব পড়তে ইচ্ছা করে - কিন্তু সমাজের তাচ্ছিল্য , বক্রহাসি , ঠাট্টা , অপমান অবহেলার ভয়ে সে দিকে হাত বাড়ানোই সম্ভব হয় না ।

এইবার আরেকটা গোপন কথা বলি - আমি শিশুবেলায় আমি খুব মেয়েদের পোশাক পরতাম , কিন্তু  আমার পুরুষাঙ্গ আছে বলে সবাই আমাকে ছেলে ভাবতো - তাই আমাকে ছেলেদের পোশাক কিনে দিতো । কিন্তু মনে মনে ছিলাম আসলে আমি একটা আস্ত মেয়ে - এই কারণেই আমার সম বয়সী চাচাতো বোনদের ফ্রক চুরি করে এনে ঠিকই মেয়েদের পোশাক পরতাম ।

শুধু ওদের ফ্রকই পরতামা না , সেই সাথে বোনদের থেকে কিছু কাঁচের চুড়ি চুরি করে এনে - ঠোঁটে লাল রঙ মেখে , চোখে কাজল দেয়ার চেষ্টা করতাম এবং হাতে চুড়ি পরতাম  ইত্যাদি - এইসব শখের সাজগোজ শেষ হলে , সবার চোখের আড়ালে বাগানে চলে যেতাম একা একা খেলার জন্য ।

কিন্তু কতক্ষণ আর একা থাকা যায় - একসময় কেউ না কেউ আমাকে দেখে ফেলতো । এবং তখনই দেখেই - দৌড়ে গিয়ে বাড়ির অন্য সবাইকে বলে দিতো - আর সবাই আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করতো । কিন্তু কেউই আমার নরম শিশু মনের কষ্ট ও ইচ্ছাটাকে বুঝতে চেষ্টাও করতো না , উল্টা আমাকে বকা দিতো । আর , বকা দিতেন আমার "মা"ও ।

তবে আমার মমতাময়ী মা আমাকে বকা দিলেও ঠিকই আমার মনের তীব্র ইচ্ছাটাকে এবং ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় কষ্টটাকেও বুঝতে পারতেন । তিনি বুঝতেন বলেই - বাবার পুরানো পাঞ্জাবী কেটে আমাকে তাঁর নিজেরা হাতে ফ্রক জাতীয় একটা কিছু বানিয়ে দিতেন এবং আমি সেইটা পরে ঘরে বসে একা একাই খেলতাম । কারো ধার ধারতাম না ।

অন্যান্য চাচাত ফুপাত ভাইবোনদের সাথে প্রচন্ড খেলতে ইচ্ছা করলেও খেলতে যেতাম না , কারণ - একে তো ফ্রকজামাটা দেখতে খুবই খারাপ উপরোন্ত সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে , মাইগ্গা বলে ক্ষেপাবে , বিভিন্ন কটূক্তি করে ঠাট্টা করবে । তারচেয়ে ভালো একাই খেলি ! কি দরকার অযথা অন্যের কাছে নিজেকে ঠাট্টার পাত্র বানানোর !!

কিন্তু এখন - এই বয়সে এসে আমি আর সেইটা নিয়ে আমি আর কোনো দুঃখ করি না - আমি এখন স্বাধীন । ইওরোপে বসে আমি এখন চাইলে যে কোনো পোশাক পরতে পারি । কেউ বাঁধা দেওয়ায় নাই । আর আমাকে দেখে অন্যান্য বাঙালীরা কে কি ভাবলো তাতে কার কি এসে যায় !! অন্তত আমার কিচ্ছু এসে যায় না ।

পোশাক পরার কারণে আমাকে কেউ কিছু বলতে আসলে উল্টা দুইটা ঝাড়ি খেয়ে যাবে । এরপরেও বাড়াবাড়ি করতে আসলে পুলিশে ফোন করে দিলে খবর করে দিবে । এইটা বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষ কিংবা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ না - এইটা ইওরোপ - যা মানবাধিকারের সূতিকাগার । এইখানে অন্যকে দমন করা চলবে না । সম্ভব না ।

মনে আছে - বাংলাদেশে থাকাকালিন আমি চুল অনেক বড় রেখেছিলাম , কারণ চুল বড় রাখা আমার খুব শখ ছিলো !! আহা ! - একদিন দুপুর বেলা হলো কি - স্থানীয় এক পত্রিকা আফিস থেকে আড্ডা ও সেই সাথে কবিতা জমা ও সংবাদ জমা দিয়ে বেড়িয়ে দুপুরের খাবার খেতে একটা সস্তা রেস্তোরার খোঁজে যাচ্ছিলাম - তখন চরম একটা দুর্ঘটনা ঘটলো !!

স্থানীয় কয়েকজন মুখচেনা বখাটে ছেলে এগিয়ে এসে আমাকে কুশল জিজ্ঞেস করলো - অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় সৌজন্যতামূলক দাঁড়িয়ে পাল্টা কুশল জিজ্ঞেস করলাম । - কিন্তু একটু তাড়া ছিলো চলে যাবার - একে তো ক্ষুধার্ত তার উপরে এইগুলা মাস্তান টাইপের বখাটে লোক - এদের সাথে কি কথা বলবো বা কিভাবে কথা বলা যায় বুঝতে পারছিলাম না !!

তো , ওদের মধ্যে থেকে একজন সিগারেট ধরালো এবং হঠাৎ সে এগিয়ে এসে আমার কাঁধের কাছের একটিবাহু চেপে ধরে জলন্ত দেয়াশলাই দিয়া আমার চুলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললো - "কি মাইগ্গা কবি ! চুলতো তো দেখি মহিলাদের মতো বড় রাখছো , চুলের বেনী করবি না কি !" আমি তো স্তম্ভিত !!

রাগে দুঃখে প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিলো । কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক লোকেরা ছোটবেলা থেকে তো নাকে কানে বুঝিয়েছে ও শিখিয়েছে যে - শারীরিক পুরুষদের তো কাঁন্না করাও নিষেধ , অপমানকর - কান্না তো করবে শুধু শারীরিক নারীরা - তাই এই প্রকাশ্যে রাস্তার উপরে কাঁদতেও পারছিলাম না । প্রচন্ড অপমানে মনে হচ্ছিলো মাটির মধ্যে গিয়া লুকাই - যেনো কাউকে মুখ দেখাতে না হয় !!

আমার উপর ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ সরূপ বখাটে ছেলেগুলো না পিটিয়ে উল্টা শারীরিক নারীদের মতো কাঁদছি - সেইটাও আবার অপমানকর । কিন্তু শারীরিক ভাবে পুরুষ হলেও - তাদের মতো নিষ্ঠুরতা তো আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো না । বরং আমি ছিলাম নরম মনের একজন শিল্পী-কবি । পুরুষতন্ত্রের ভাষায় - "মাইগ্যা ভীরু কাপুরুষ" !!

তাই , তখন - কি করবো কি বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না ! আতংকিত অবস্থায় থরথর করে আমার হাত-পা কাঁপতে ছিলো ! অথচ ওরা হাহাহাহা করে হাসছে । আমার কাধে একটা শান্তিনিকেতনী পাটের ব্যাগ ছিলো , সেইটা মাথার উপর চেপে ধরে কোনোমতে চুলের আগুনটা নেভালাম । কিন্তু আমার মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো ।

তবুও ওদের কিছু বলতে পারছিলাম না - কিছু বললে না জানি আবার উল্টা মাইর খেতে হতে পারে ভেবে ! হতে পারে জোর করে নরসুন্দরের কাছে নিয়া গিয়া চুল কাটাইয়া আর্মিছাট করে দিতে পারে । যদিও ওদের মাথার চুল আর দশজনের চাইতেও বড় কিন্তু আমার অপরাধ আমার চুল ঘাড়ের নীচে নেমে গেছে ।

চুল বড় রাখার জন্য প্রকাশ্যে রাস্তায় ভরা সমাজে এইভাবে হঠাৎ চরম ওপমানিত হতে হবে কখোনো কল্পনাও করতে পারি নাই ! ওইদিন মানসিকভাবে এতোটা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে - পায়ের উপর দিয়ে চলন্ত ট্রাক চলে গেলেও এতোটা যন্ত্রণা অনুভব করতাম না । তাই ওই ঘটনাকে দুর্ঘটনাই বলি । ওইটা একটা দুর্ঘটনা না তো কি !?

ওদের ওই বর্বরতম কাজের জন্য কারো কাছে নালিশ জানাতে পারিনি পর্যন্ত । কারণ , যার কাছে নালিশ জানাবো সেই দাঁত ভ্যাটকাইয়া বক্রহাসি হাসতে হাসতে বলবে - "তা , পুরুষ হয়ে মহিলাদের মতো চুল বড় রেখেছো কেনো ? ওরা তো চুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে , জোর করে তো আর চুল কেটে দেয় নাই । এখনি গিয়া চুল কাটো ।"

এখন তো পত্রিকায় দেখি ডিসি এসপি পুলিশ মেজিস্ট্রেট সবাই একই কাজ করছে বড় চুলের ছেলেদের দেখলে ; না , চুলে আগুন দিচ্ছে না তবে জোর করে চুল কাটিয়ে দিচ্ছে ।  হাহ ! এই হলো আমাদের বর্বর সমাজের "বাল"এর বাংলাদেশ । ওই বাংলাদেশে বসে ওই সময়ে আমার পক্ষে শাড়ি পরে প্রকাশ্যে আসা কি সম্ভব ছিলো ??

যদি ভুল করেও কোনো একদিন কোনো উৎসবে শাড়ি পরে যাওয়ার জন্যে রাস্তায় বেড়োতাম - উৎসব অনুষ্ঠান পর্যন্ত যেতে হতো না - একদল কুপমুন্ডক মুর্খ আমাকে দেখে হাহা করে হাসতে হাসতে মরে যেতো ও খিস্তিখেউর শুরু করতো - এবং আরেকদল মুর্খ এসে আমার শাড়ি সায়া ব্লাউজ টেনে হিঁচড়ে খুলে নিয়ে নগ্ন করে দিয়ে পাছা ও পিঠের উপর পেটাতো ।

শুধু কি তারা মেরেই খান্ত হতো ! ? ছবি তুলে পত্রিকায় দিয়ে দিতো । অর্থ্যাৎ পুরুষ হয়েও শাড়ি পরার অপরাধে অপমানের চুড়ান্ত করে - তার পরেই ছাড়তো । অসহ্য ! ভাবতেও পারছি না । শুধু কি পুরুষরা ! ? পুরুষতান্ত্রিক পুরুষদের ঘরের দাস যেইসব আত্মসম্মানবোধহীন নারীরা আছে - তারাও একেকজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পঢ়তো । আহারে আমার বাংলাদেশ !!

আমি নিজেকে সর্বপ্রথম মানুষ মনে করি - কিন্তু এইটা বিশ্বাস করি - কোনো নারী , সে নারী বলেই কোনো অবহেলা পেতে পারে না । ওই সময় আরেকটা সমস্যা ছিলো - সেইটাতেও আমি চরম ভাবে অপমানিত হয়েছি প্রতিনিয়ত । আমার ওই বয়সে খুব শখ হতো রঙীন কাপড় পরার অর্থ্যাৎ বিভিন্ন ফুল , লতাপাতার আঁকা ছাপার কাপরের পোশাক পড়ার খুব শখ ছিলো তখন ।

তো , আমি একবার বসন্তকালে গরম পরা শুরু করলে - ছাপার বিভিন্ন ধরনের সুতী থানকাপর কিনে দর্জীর দোকান থেকে কয়েকটা ছোট পাঞ্জাবী আর সাদা ও সোনালী রঙের চুড়িদার পায়জামা বানালাম এবং সেগুলো নিয়মিতভাবে একেক দিন একেকটা পরতাম এবং প্রতিদিন মানুষের কাছ থেকে "মাইগ্যা" অপবাদ ও হাসি ঠাট্টা অপমান সহ্য করতে হতো ।

সবচাইতে বেশী তাচ্ছিল্য শুনতে হতো লাল ও গোলাপী ছাপার ছোট পাঞ্জাবী দুইটা পরলে । - আমাকে বলা হতো বাইরের পাঞ্জাবির লাল রঙের মতো আমার ভিতরেও লাল ! অর্থ্যাৎ আমার যৌনাঙ্গের জায়গায় প্যানিস নাই বরং সেখানে নারীদের মতো লাল রঙের যোনী আছে !! কারণ , নারীদের মতো আমি বিভিন্ন রঙের ও ফুল , লতাপাতার ছাপার কাপড়ের পোশাক পরি ; আবার হাটাচলাও কিছুটা মেয়েলী চালে ইত্যাদি ।

সেই অপমান গুলো শুধু যে আড়ালে আবডালেই করতো তা না , কয়েকজন আবার আমার মুখের ওপরেও বলে বসতো । কিন্তু অপমান গুলো উপরে উপরে গায়ে না মেখে তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করলেও - মনে মনে আমি খুব কষ্ট পেতাম । নিজেকে আমার তুচ্ছ ও হাস্যকর মনে হতো তখন । কিন্তু রঙিন পোশাকগুলাও পড়ার লোভ সামলাতে পারতাম না ।

তবে আশ্চর্য হতাম এইটা ভেবে যে - আমাকে মাইগ্যা বা মেয়েলী বলে গালি দেওয়া হচ্ছে কেনো !! ?? মেয়েরা বা নারীরা কি খারাপ কিছু - যে তাঁদের নামে গালি দিতে হবে !! ?? আর আমার আচরণ যদি মেয়েদের মতো হয় তবে সমস্যা কি ?? মেয়েরা যেহেতু মানুষ ও আমিও যেহেতু মানুষ এবং আমি যেহেতু একজন মানুষনারীর গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছি সেহেতু আমার আচরণ মেয়েলী হতেই পারে !!

এক মানুষের আচরণের সাথেই তো আরেক মানুষের আচরণের মিল থাকার কথা , তাই না ? সুতরাং মেয়েলী বা মাইগ্যা বলে গালি দিলে আমি অপমান বোধ না করলেও গর্বিতও হতে পারতাম না - ওই সময় মানবতাবাদ বা নারীবাদ সম্পর্কে অতোটা জানাশোনা পড়ালেখা না থাকার কারণে !! তাই , মাইগ্যা বা মেয়েলী শব্দগুলা আমাকে অপমানিত না করলেও ওদের গালি দেওয়ার বিশ্রী অভিব্যক্তি ও ভঙ্গিটা আমার চরম মনোকষ্ট ও অপমানের কারণ ছিলো ।

আমরা মানুষ যেইহেতু ভিন্ন তাই আমাদের পছন্দের ভিন্নতা থাকবে এইটাই স্বাভাবিক । অবশ্যই স্বাভাবিক । এই পছন্দের ভিন্নতা আছে বলেই পৃথিবীটি এতো বৈচিত্র্যময় , এতো সুন্দর । কেউ রঙিন জিনিস পছন্দ করবে কেউ সাদাকালো , কেউ মিষ্টি খাবার পছন্দ করে কেও টক , কেউ গান গাইতে পছন্দ করে , কেউ ছবি আঁকতে , নাচতে , অভিনয় করতে ইত্যাদি - সবার পছন্দ এক হয়ে গেলে সৃজনশীলতা থাকতো না আর জীবনটা আনন্দময়ও হতো না ।

আমরা শারীরিক ভাবে নারী বা পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে মানুষ । মনের কোনো লিঙ্গ হয় না । মানসিকভাবে আমরা সবাই মানুষ । যদি কেউ বলে সে - মানসিকভাবে নারী বা পুরুষ - তাহলে সেইটা ভুল বলা হবে । যা পুরুষতান্ত্রিক কথা বা আচরণ । তাই , একটা মানুষ যেইরকমই হোক সে মানুষ হিসেবে সমান সম্মান , ভালোবাসা পাবে ও প্রতিটা অধিকার সমানভাবে ভোগ করবে - সে কোনো অন্যায় না করলেই হলো ।

ইদানিং এক ফেইসবুক বন্ধু ও তার কয়েকজন বন্ধুকে দেখছি - শাড়ি পরিধান করা ছবি দিচ্ছি এবং বিভিন্ন জায়গা , সভা , সেমিনারে যোগ দিচ্ছে । তারা প্রত্যেকেই শারীরিকভাবে পুরুষ , হয়তো তারা মানসিকভাবে নিজেদের নারী ভাবতে পারে !! আমি ঠিক জানি না - এই বিষয়ে তাদের সাথে কথা বা আলোচনা করার অবকাশ হয় নাই ।

যাইহোক , তাদের দেখে খুব খুব আফসোস হয় , আমার অতিতের কথা মনে করে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় -  কারণ , তাদের বয়সে আমি যা করতে পারি নাই - সেইটা তারা করার সাহস দেখিয়েছে এবং এখন আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে । হয়তো একসময় আমি ঠিকই একদিন কোনো এক উৎসবে শাড়ি পড়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়বো - কিন্তু কবে ? জানি না !!!!

- যাইহোক , এই প্রসঙ্গে অর্থ্যাৎ পোশাক নিয়া মুর্খ , অসচেতন কুপমুন্ডক লোকগুলোর যেই সামাজিক টাব্যু সেইটা ও বাধানিষেধে ভরা তাদের বদ্ধমানসিকতা নিয়া অন্য আরেকদিন , অন্য কোনো অবকাশে বিস্তারিত লিখবো বলে আশা রাখছি ।

আজকের মতো এখানেই রাখি , কারণ , ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতো - শাড়ি নিয়া কথা বলতে এসে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি - - সব কথার শেষ কথা হইলো - নারী যেনো তার পোশাক নির্বাচন করতে গিয়া শাড়িতেই আটকে না থাকে -

শাড়ি সহ অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা যেতে পারে বিভিন্ন উৎসবে - যদি নারী তা স্বইচ্ছায় পরতে চায় আর কি । কিন্তু কেউ তার ওপর পোশাক চাপিয়ে দিতে পারবে না । ঐতিহ্য যদি রক্ষা করতে হয় তবে পুরুষনারীহিজড়া সবাই করবে - না করলে নাই । নারীকেই কেনো বাধ্য হয়ে একা ঐতিহ্য রক্ষা করে চলতে হবে !! ??

নারী যেনো তার সাচ্ছন্দ ও সুবিধা মতো , ঋতু , পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে যে কোনো আরামদায়ক পোশাক বেছে নেয় , যাতে চলতে ফিরতে বাধার সম্মুখীন না হয়ে সুবিধা অনুভব করে !! নারী , কে কি বললো - তাতে কান না দিয়া - তুমি তোমার সুবিধা মতো এগিয়ে যাও - - এমন কি আমার লেখা এই কথাগুলোতেও কান দেয়ার কোনো দরকার নাই ।

নারী , তোমার যা ভালো লাগে , যা যৌক্তিক বলে মনে হয় - তাই করো , করতে থাকো - - "ভালো থেকো ফুল , মিষ্টি বকুল" !!

'শাড়ি'
-খান ওয়াহিদুজ্জামান
(০১মার্চ - ২৩জুন , ২০২০)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. যদিও বলা হয় পোশাক বিষয়টা ব্যক্তিগত কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সোসাইটি,ধর্ম,কর্পোরেট সমাজ গুলো মানুষকে বিভিন্ন পোশাক পড়তে বাধ্য করে।আর যদি নারীকে পোশাক সেটাতে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো সবকিছুতেই সবজায়গায় সব ভাবেই বাধ্য করে আসছে।পুরুষের পছন্দ অপছন্দ গুলো নারীকে গ্রহন করতে একপ্রকার বাধ্য করা হচ্ছে।

    উত্তরমুছুন

মুক্তচিন্তার সাথে হোক আপনার পথ চলা।