এই ব্লগটি সন্ধান করুন

ধর্ষন এবং বাঙালি পুরুষ

বাঙালি পুরুষ, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম পুরুষ হচ্ছে পৃথিবীর নবম আশ্চর্য, যাদের অধিকাংশের চরিত্র ধর্ষকামী, তাদের ধর্ম আছে, নৈতিকতা নেই, তাদের স্ত্রী থাকে, প্রেমিকা থাকে কিন্তু সহযাত্রী বা জীবনসঙ্গী থাকে না, তারা নেতার মতো হুঙ্কার ছাড়তে ভালোবাসে, অথচ তারা প্রকৃতবিচারে চামচার মতো তোষামোদী। তারা মনে করে একটি মেয়েকে বিয়ে করা মানে তাকে সম্পদে পরিণত করা, একটি সম্পর্ককে সম্পদে পরিণত যায়, একটি মানুষকে নয়, বাঙালি মুসলিম পুরুষ এটি জানে না।
ধর্ষনের শিকার



নিজ স্ত্রীর অনিচ্ছায় যৌনাচরণ করলে যে তা ধর্ষণ কিংবা বিরুদ্ধ যৌনাচরণ হতে পারে এই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই অধিকাংশ বাঙালি মুসলিম পুরুষের। ধর্ষণের মতো প্রাগৈতিহাসিক ও মধ্যযুগীয় বর্বর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নষ্টামিকে বাঙালি মুসলিম পুরুষ কোরানের আয়াত কপচিয়ে বৈধ করতে চায়- তাদের মতে ধর্ষণের জন্য মেয়েটি দায়ী, তার অবাধ পোষাক, চোখের চাহনি বাঙালি মুসলিম পুরুষকে কামান্বিত করে তোলে, অথচ সেই পুরুষের মাথায় এই চিন্তা খেলে না যে বাতাসে পাতা নড়ার জন্য বাতাসই দায়ী, পাতা নয়, পুরুষ তার যৌনচিন্তা অদমিত লিঙ্গকে সামাল দিতে পারে না বলেই এইসব নষ্টাচার। এইসবের মূলে মূলত আছে ধর্মীয় অপশাসন আর সুনিষ্ট যৌনশিক্ষার অভাব। বাঙালি মুসলিম পুরুষের যৌনশিক্ষা বলতে মূলত চটি পড়ে হাত মারা, বন্ধুবান্ধব সমবয়েসী কিংবা মুরুব্বীদের কথাবার্তায় কান পেতে শোনা অযাচিত কিছু অপতথ্য, তারা জানে না যৌনতা শিল্প, তারা জানে না যৌনতা প্রবৃত্তির চাবি, তাদের মতে যৌনতা কেবল কামনা। বিজ্ঞানের বইয়ের পাতায় যৌন-বিষয়ক অধ্যায়কে এইচআইভি ভাইরাসের মতো এড়িয়ে চলতে পারলে বাঁচে বাঙালি মুসলিম পুরুষ, তারা বই পাঠ করে না, মাত্র পড়ে পাশ করার জন্য, তারা কবিতা গল্প পড়ার চেয়ে কাসেম বিন আবুবকরের যৌনসুড়সুড়ি দেয়া অপন্যাস পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কিন্তু যৌনবিষয়ক কোনো ভালো বই কিংবা জার্নালের আর্টিকেল পড়বে না। কুসংস্কার আছে যে পুরুষ মানুষরা গড়ে প্রতি ৭ সেকেন্ডে একবার যৌনতা নিয়ে চিন্তা করে, দেখা যাবে যে বাঙালি মুসলিম পুরুষের জন্য এটি প্রতি ৩ সেকেন্ডে একবার। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চাওয়ার মতো বাঙালি মুসলিম হুরপরীর জন্য ধর্মকে বেছে নেয়, ধর্মের নৈতিকতার জন্য নয়, তাদের কাছে সবকিছু মূলত যৌনলালসার জন্য, ফ্রয়েডীয় অপমনোবিজ্ঞান বাঙালি মুসলিম পুরুষের জন্য অনেক মানানসই।
বাঙালি মুসলিম পুরুষের ধর্ষকামী মনোভাবের আলামত পাওয়া যায় পুলিশ রিপোর্ট, ধর্ষণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যানে। যেমন, জানুয়ারি ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১২ সাল নাগাদ চলমান এক তথ্যজরিপে দেখা গেছে যে বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে (অশহুরে এলাকা) পতি-নয় এমন লোক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রতি ১০০ জনে ৫.৪ জন নারী (Jewkes, Fulu, Roselli, & Garcia-Moreno, 2013)। শুধুমাত্র ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে রিপোর্ট করা ধর্ষণের শিকারদের কাছ থেকে জানা যায় যে আক্রান্তদের ৭০% ভাগ হচ্ছে ২০ কিংবা তার-ও কম বয়েসী নারী বা মেয়ে, যাদের দুই-তৃতীয়াংশ (৬৪.৬%) আক্রান্ত হয়েছেন পরিচিত লোক দ্বারা, নিজের বাড়িতে বা বাড়ির আশপাশের এলাকায় (৬৪.২%) (Ali, Akhter, Hossain, Khan, 2015)। যেহেতু বাঙলাদেশ, এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা এশিয়াতে ধর্ষণ-পরবর্তীতে আক্রান্তদের যে পরিমাণ নাজেহাল করা হয় ধর্ষণ হয়েছে কিনা তা যাচাই করার নামে এবং সামাজিকভাবে আক্রান্তের চরিত্র ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর যে কালিলেপন করা হয় তাতে অনেক আক্রান্তই ধর্ষণকে রিপোর্ট করেন না, কিংবা করতে দেয়া হয় না। পূর্বোল্লিখত গবেষণাপত্রটি মতে, শুধুমাত্র ১৪.২% আক্রান্ত ব্যক্তিরা ধর্ষণ-সংক্রান্ত মেডিকেল পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য রিপোর্ট করেছেন ২৪ ঘণ্টার মাঝে, এবং প্রতি চারটি ধর্ষণের একটি হচ্ছে গণধর্ষণ!
ধর্ষনের কারণ


গণধর্ষণ যে কতোটা বর্বর আর অমানবিক সেটি ছাড়া-ও এটি আরো কিছু বিষয় নির্দেশ করে- ১. পুরুষদের মাঝে ধর্ষণ একটি সাধারণ সম্মতিগতভাবে পরিকল্পিত ব্যাপার যে তারা এটি সহযোগীদের সাথে মিলেমিশে ধর্ষণ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা বা অপরাধবোধ অনুভব করে না এবং সমাজে এর প্রতি যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না, ২. নারীদেরকে জোরপূর্বক পাওয়া যায়- এই ধারণাকে পাকাপোক্ত করা হচ্ছে, ৩. নারীরা তাদের কাছে ভোগের সামগ্রী ও বাচ্চা-বানানোর মেশিন, মানুষ নয়, ৪. গণধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধ শুধুমাত্র ধর্ষণেই সীমাবদ্ধ থাকে না, শারীরিক অত্যাচার (যেমন, স্তন কেটে ফেলা কিংবা যোনিতে বিভিন্ন জিনিস প্রবেশ করানো) এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যা করা হয় আক্রান্ত নারীকে।

বাঙালি মুসলিম পুরুষগণ যুক্তিবিদ্যা কিংবা জ্ঞানবিজ্ঞানে বিজ্ঞ না হলে-ও বউ পেটাতে ওস্তাদ। শহুরে বাঙালি মুসলিম বাবুরা-ও পিছিয়ে নেই, জাতিসংঘের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের পরিচালিত সমীক্ষা মতে শহরাঞ্চলের ১০ শতাংশ পুরুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে একজনকে ধর্ষণ করেছে ( Fulu et al., 2013)। সম্পর্কে আছেন এমন পুরুষরাই বেশি ধর্ষণ করেন, মনে হয় যেনো তারা ধর্ষণের সংজ্ঞাই জানেন না, জানেন না যে যৌনতায় সম্মতি না পেলে তা যে কারো সাথেই হোক না কেনো তা ধর্ষকামী আচরণ। এবং এইসব পুরুষরা ধর্ষণ করা শুরু করেন অতি অল্প বয়েসেই, তাদের কৈশোর বয়েসেই ( Fulu et al., 2013)। তারা মনে করে তারা সম্মতি পাক অথবা না পাক যেকোনো নারীর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হতে কোনো বাঁধা নেই। দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হচ্ছে আনন্দলাভ করা বা বিনোদনের জন্য ধর্ষণ করা! অনেক সময় রাগের বশবতী হয়ে অথবা শান্তি দেয়ার জন্য অনেকে ধর্ষণ করেন, জরিপ মতে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে যে অধিকাংশ ধর্ষকই কোনো আইনী ব্যবস্থার সম্মুখীন হন নি বা শাস্তি পান নি, এতে শুধু ধর্ষক পার পেয়ে যাচ্ছেন তা নয় বরং ধর্ষণকে উৎসাহিত করা হয়। সাম্পর্কিক ধর্ষণের (partner rape) বা বৈবাহিক ধর্ষণের (marital rape) ক্ষেত্রে তো বিচার তো দূরের কথা একে অপরাধ হিসেববেই গণ্য করা হয় না। কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বা অবস্থায় ধর্ষণ বেশি হয় - যেমন, যৌনলেনদেনের ক্ষেত্রে ( transactional sex), অনেক যৌনসঙ্গী থাকলে, যে ব্যক্তি এমনিতেই নারীদের প্রতি শারীরিক অত্যাচার করেন, পুরুষদের বাড়ির বাইরে আগ্রাসনের শিকার বা শিকারী হওয়া ইত্যাদি ( Fulu et al., 2013)।

সরকারী জরিপ অনুসারে পাওয়া তথ্য-ও ভয়াবহ। ২০১১ সালে প্রতি দশজন নারীর নয়জন তাদের স্বামী বা সঙ্গী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন (৮৭%), বাঙলাদেশ পরিসংখ্যান সংস্থার (Bangladesh Bureau of Statistics) দেয়া তথ্য মতে, যাদের মধ্যে ৭৭% শতাংশ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন গেলো ১২ মাসের মাঝেই। শুধু তাই নয়, এক-তৃতীয়াংশ নারী স্বামী বা সঙ্গীর আরো ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হবেন এই ভয়ে পুলিশকে রিপোর্ট করেন নি কিংবা ডাক্তারের কাছে যান নি চিকিৎসার জন্য, নীরবে সহে গেছেন। যদিও এই নির্যাতনের সবটি ধর্ষণ নয় তবুও এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নারীদের প্রতি বাঙালি মুসলিম পুরুষদের মনোভাব কী। আমি শুধু বাঙালি মুসলিম পুরুষের কথা বলছি যেহেতু বাঙলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সর্বোচ্চ আদালত কিছুদিন আগে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রকে মুসলমানী করিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বজায় রেখে। বাঙলাদেশ পুলিশ বাহিনির পরিসংখ্যান অনুসারে নারী ও শিশুদের প্রতি রিপোর্ট করা নির্যাতন ও নানাবিধ অবমাননার সংখ্যা ২০০২-২০১৫ সাল নাগাদ প্রায় ২৪৩৩৭৩, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না নীরবে সহ্য করা অথবা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না নানা রকম কারণে এমন নারী ও শিশু নির্যাতন মেলালে এই সংখ্যা দ্বিগুণ তিনগুণ হলে-ও আশ্চর্যের কিছু নেই।

ধর্ষণ প্রমাণের জন্য বাঙলাদেশ এখনো দুই-আঙুলের পরীক্ষা করে ("two-finger test") ধর্ষণ-সংক্রান্ত তদন্তে। ডাক্তার কিংবা তাদের সাগরেদরা (যাদের সঠিক যোগ্যতা আছে কি না তা সন্দেহজনক) আক্রান্ত নারীর যোনিতে দুই আঙুল প্রবেশ করিয়ে সাবজেক্টিভভাবে ধারণা করে নেন যে সেটিতে লিঙ্গ প্রবেশ করা হয়েছিলো কি না। যোনি সম্পর্কে যাদের অল্প কিছু ধারণা আছে তারা জানেন যে এটি অনেক নমনীয় অঙ্গ, আপনি দুই আঙুল কি তিন আঙুল ঢুকালে-ও ঢুকবে, তার কারণেই বিভিন্ন আকারের লিঙ্গ ধারণ করতে পারে এক যোনি, কিংবা সন্তান জন্মের পর এটি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। দুই-আঙুলের পরীক্ষা দ্বারা ধর্ষণ হয়েছে কি না তা জানতে চাওয়া অনেকটা রাবারের ব্যান্ডকে টেনে আবার ছেড়ে দেয়ার পরা সেটি পূর্বাবস্থায় ফিরে গেলে তা দেখে নির্ণয় করা যে সেই ব্যান্ডটি অন্য কেউ স্পর্শ করেছিলো কি না নির্ণয়ের মতো হাস্যকর ব্যাপার। আর "সতীচ্ছেদ" তো যেকোনোভাবেই ছিঁড়ে যেতে পারে কোনো প্রকার সঙ্গমেরই আগেই (যেমন, সাইকেল চালানো)। অথচ ধর্ষণ হয়েছে কি না সেটি নির্ণয়ের জন্য বীর্য, রক্ত, যোনি নিঃসরণ, লালা, যোনির এপিথেলিয়াল কোষ সংগ্রহ করে ধর্ষককে সনাক্ত করা যায় সহজেই, ডিএনএ প্রোফালিং করা যায় অনেক কম খরচে এবং অন্যান্য ব্যবস্থার চেয়ে যা কিনা অনেক নির্ভরযোগ্য। ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাঙলাদেশকে ধর্ষণ-সংক্রান্ত ১৮৭২ সাল থেকে চলে আসা আইনের হালনাগাদ করতে হবে। শুধুমাত্র যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ করালেই ধর্ষণ হবে এমন ধারণা বাতিল করতে হবে, অনেক উন্নত দেশেই পায়ুসঙ্গম, মুখসঙ্গম ইত্যাদিকে ধর্ষণের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নিচে আমি ধর্ষণ সংক্রান্ত মনোবৈজ্ঞানিক (এবং কিছু আইনগত) বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। যেহেতু আমার পড়াশোনা কানাডায়, তথ্য ও তথ্যসূত্র কানাডা-কেন্দ্রিক, তবে মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য না-ও থাকতে পারে বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপটে।

কানাডার (এবং আমেরিকা) আইনানুসারে ধর্ষণ মূলত দুই প্রকার: বলপূর্বক ধর্ষণ (forced rape) এবং সংবিধিবদ্ধ ধর্ষণ (statutory rape)। বলপূর্বক ধর্ষণ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির অনিচ্ছায় তার সাথে বলপূর্বক অথবা কৌশলে যৌনসঙ্গম বা যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া; অন্যদিকে, সংবিধিবদ্ধ ধর্ষণ হচ্ছে সম্মতি দেয়ার বয়েসের নিচে বা নাবালক কারো সাথে (যেমন- ১৩ বছরে মেয়ের সাথে) যৌনসঙ্গম বা যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া, এইক্ষেত্রে নাবালক (নাবালিকা) "সম্মতি" দিলে-ও সেটি ধর্ষণ কারণ সে সম্মতি দেয়ার বয়েসী নয়, আইনগতভাবে সে এখনো কারো শিশু বা তার অভিভাবক আছে।

বলপূর্বক ধর্ষণের ক্ষেত্রে একটি জিনিস মনে রাখা ভালো যে এটি অন্যান্য প্রাণীদের মাঝে-ও দেখা যায়, যেমন গরিলা, বানর-জাতীয় প্রাণী, যারা বিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের নিকট্য। অনেকে তাই মনে করেন যে বিবর্তনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বংশবৃদ্ধিকরণের ক্ষেত্রে এটি একটি অভিযোজিত ক্রিয়া যেহেতু "পুরুষ" বিভিন্ন নারীর সাথে সঙ্গমের মাধ্যমে নিজের জিন ছড়িয়ে দিতে পারেন বা অনেক সন্তান জন্মদান করতে পারেন (Lalumiere et al., 2005)। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে মানুষের বিবেক ও সভ্যতা আছে, তাই অনেক আচরণ এককালে বিশেষ করে হাজার লক্ষ বছর আগে বিবর্তনে কাজে লাগলে-ও এখন নিস্ফল, এবং সেই আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ইতিহাস মতে, যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যেকোনো সমাজে ধর্ষণের হার বেড়ে যায়, হয়তো পুরুষরা মনে করে যুদ্ধাবস্থার কারণে অথবা ভাঙা সামাজিক-কাঠামোর জন্য তারা পার পেয়ে যাবে, অথবা এটি শত্রুর প্রতি হিংস্রতা প্রকাশের আরেকটি পন্থা (Lalumiere et al., 2005)।

যদি-ও ধর্ষণের নানা কারণ থাকতে পারে তবে মূলত দেখা যায় যে হয় এটি পূর্বপরিকল্পিত অথবা আবেগতাড়িতভাবে (সেই আবেগ রাগ, হিংসা, হিংস্রতা অনেক কিছু হতে পারে) 'মূহুর্তের তাপে'র ফল। কানাডায় প্রায় ধর্ষণের ৭০% ঘটে মাদক-প্রভাবিত বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, যেমন হয় ধর্ষক মাদক বা ড্রাগের প্রভাবে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে, অথবা যেকেউ নেশাগ্রস্ত হলে তার দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা (Marshall & Barbaree, 1990)। অনেক ধর্ষণ ঘটে ধর্ষিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা থেকে (যেমন, বৈবাহিক ধর্ষণ বা সাম্পর্কিক ধর্ষণের ক্ষেত্রে)। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষক বিকৃত যৌনাচারের জন্য ধর্ষণ করে, যেমন যোনিতে অদ্ভুত সব বস্তু ঢুকিয়ে বৈকল্যিক আনন্দ লাভ করা। অর্থাৎ, ধর্ষণ কেবল যৌনানন্দ লাভের জন্য হয় না, হিংস্রতা, আগ্রাসন, ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য-ও হতে পারে। অনেক পুরুষ-ও ধর্ষণের শিকার হন, যেমন যৌনানন্দ লাভ বা বিকৃত যৌনাচারের কারণে বয়েসী কোনো নারী দ্বারা নাবালক বা বয়েসে ছোট কারো ধর্ষিত হওয়া, কিংবা জেল, মক্তব্য বা অন্যত্র অন্য পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হওয়া। তবে যেহেতু অধিকাংশ ধর্ষণই পুরুষরাই করে তাই নিচের আলোচনায় সেই সম্পর্কে বেশি আলোকপাত করা হবে।

অনেক ধর্ষণ হয় অভিসারীয় ধর্ষণ (acquaintance rape or date rape), যার প্রাদুর্ভাব কানাডায় ও বাঙলাদেশের শহরাঞ্চলে বেশি, যেমন- অভিসারে গেলে প্রেমিক দ্বারা প্রেমিকার ধর্ষিত হওয়া। এই ধরণের ধর্ষণ পুরোপুরি অচেনা লোক দ্বারা ধর্ষণের চেয়ে তিনগুণ বেশি (Kilpatrick & Best, 1990)। সাধারণত, অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক আক্রান্ত ব্যক্তির পূর্বপরিচিত (Stermac, Du Mont, & Dunn, 1998)। ক্ষমতা আছে এমন লোকজন তাদের ক্ষমতা বা প্রভাব অপব্যবহার করে ধর্ষণ করেন, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ইস্কুল কলেজের শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থী ধর্ষিত হওয়া, কিংবা কাজে উর্ধ্বতন কর্মকতা দ্বারা কর্মচারী ধর্ষিত হওয়া; এইসব ধর্ষণের ঘটনা সাধারণত চেপে যাওয়া হয়, যেহেতু ধর্ষিত ব্যক্তি নিজেকে অসহায় মনে করেন কর্তৃপক্ষ বা কর্মকতার বিপক্ষে, কিন্তু এইসব ধর্ষণের প্রচার পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়, যেহেতু কেবল ব্যক্তি নয় বরং প্রতিষ্ঠান-ও (বা প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদা) জড়িত, তাই এইসব ধর্ষণের কথা প্রকাশ করা জরুরী- ফলে জনসাধারণ সচেতন হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি ন্যায়বিচার পেতে পারেন।

ইদানীংকালে, অভিসারীয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে ট্রাঙ্কুইলাইজার Rohypnol বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ঔষধটি গন্ধহীন, স্বাদহীন এবং সহজেই যেকোনো পানীয়-এর সাথে মিশিয়ে দেয়া যায়। এটি গ্রহণের ফলে ব্যক্তি সাধারণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং কী থেকে কী ঘটেছে সেই সম্পর্কে তেমন স্মৃতি মনে করতে পারেন না পরবর্তীতে, অর্থাৎ সাময়িক স্মৃতিলোপ হয়। জরিপ-গবেষণায় দেখা গেছে যে অনেক ধর্ষক, যারা অভিসারে গিয়ে ধর্ষণ করেন তারা অনেকেই এই ঔষধটি ব্যবহার করে অনেক নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। ১৯৯০ সালের পর থেকে অ্যালকোহল পান করেন যারা তাদের মাঝে এই ঔষধটি ব্যবহারের হার ক্রমেই বাড়ছে অভিসারীয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে। যেমন, Du Mont এবং অন্যান্যরা (2009) অন্টারিওতে (কানাডার একটি প্রদেশ) ড্রাগ-সম্পর্কিত ১৮৪টি ধর্ষণের ঘটনা তদন্ত করে দেখেছেন যে ৬২.৫% (বা ১১৫ জন) নারীই অভিসার ও ধর্ষণ সম্পর্কিত ঘটনার পুরোপুরি স্মৃতি হারানোর কথা বলেছেন। গবেষকদের মতে এইসব ঔষধ যেনো খোলাবাজারে বা ফার্মাসিতে সহজেই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে এবং নারীদেরকে এই ব্যাপারে সচেতন করতে হবে, এবং তারা যেনো অভিসারে গেলে সচেতন থাকে (বিশেষ করে প্রথম দিকের অভিসারসমূহে)।

অনেকে বিশ্বাস করে থাকেন যে ধর্ষকরা রূপসী সুন্দরী নারীদেরকে ধর্ষণ করে থাকেন, কিন্তু এই ধারণা ভুল ও প্রচলিত ভ্রান্তি। যদিও অনেক সুন্দরী নারী ধর্ষণের শিকার হন তার মানে এই নয় যে অন্যরা নিরাপদ, কারণ, মানসিক বৈকল্যে ভোগা বা লম্পট ধর্ষক বয়েস ও শারীরিক সৌন্দর্যের তোয়াক্কা না করে এক বছরের শিশু কিংবা আশি বছরের বৃদ্ধাকে-ও ধর্ষণ করে থাকে। ধর্ষণ শুধু শারীরিকভাবেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্ষতি করে না, দীর্ঘ স্থায়ী মানসিক অশান্তি কষ্টের কারণ-ও হয়।

শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলে সেটি তাদের পরবর্তী জীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যে শিশু বা অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় সে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে, যেহেতু সে যৌনতা বিষয়ে অজ্ঞ, বিশেষ করে ঘটনা দামাচাপা দেয়ার জন্য শিশুদেরকে ঘটনাটি "ভুলে" যেতে বলা হয়, অথচ উচিত ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা, যেহেতু পরবর্তীতে এই ঘটনা আর ঘটার সুযোগ না হয় অথবা তার মনে মানসিক অশান্তি সৃষ্টি না করে অথবা যৌনতা সম্পর্কে যেনো তার মনে ভীতি বা অনিহার সৃষ্টি না হয়।

কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ তাদের স্বাভাবিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেক অভিভাবক লজ্জা বা গোপনীয়তার জন্য অন্যত্র চলে যেতে চান কিংবা মেয়েটিকে "ঘরবন্দী" করে ফেলেন, যা তাকে স্বাভাবিক যোগাযোগ ও বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

সাধারণত, ধর্ষণের সময় অনেক নারীই তার জীবনের আশংকা করেন, এবং শক্তি সামর্থ্য দিয়ে ধর্ষককে থামাতে পারছেন না এই চিন্তা তাকে অসহায় করে তোলে। ফলে ধর্ষণের সপ্তাহ মাস পরে-ও অনেকে গভীরভাবে অপমানিত বোধ করেন, তারা অনুশোচনায় ভোগেন কেনো তারা অই ধর্ষককে "থামাতে" পারে নি সেই অক্ষমতার জন্য, এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজেকে দায়ী করেন, অনেক সময় প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা-ও করেন। অনেকে দুঃস্বপ্ন দেখেন প্রায়ই, কাজে-কর্মে স্বাভাবিকভাবে মনোযোগ দিতে পারেন না, এবং অনেকে বিষণ্নতা (depression) ও পিটিএসডিতেও (PTSD: Post-traumatic stress disorder; দুর্ঘটনা-পরবর্তীকালীন মানসিক পীড়ন) ভুগেন। নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ হচ্ছে পিটিএসডিতে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ (Cloitre, 2004)। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির নিকটজনের উচিত ব্যক্তিকে মানসিকভাবে সাহায্য করা ও মনোবল বজায় রাখতে সহযোগিতা করা। অনেকে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, এবং এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তাই আক্রান্ত ব্যক্তির উপর নজর রাখা উচিত যেনো এইরকম কিছু না করে বসে। যদি ধর্ষণ বাহিরে হয়ে থাকে তবে অনেকের মাঝে সেই স্থান বা সেই স্থানের মতো জায়গার উপর ভীতি জন্মে। অনেকে বর্ণনা করেন যে তাদের প্রায় মনে হয় যে কেউ একজন তাদের পিছনে ওতপেতে আছে বা ভিড়ের মাঝেও তাদের একা বা ভয় লাগে। অনেকক্ষেত্রে পুলিশ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এদের কাছে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাদেরকে ঘটনা বারবার বর্ণনা করতে হয়, ফলে তারা সেই দুঃসহ স্মৃতিকে "তাজা" করে তোলেন, যেটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

McCann, Sakheim, এবং Abrahamson (1988) দেখেন যে ধর্ষণ নারীদের স্বাভাবিক কার্যাবলি বা বিকাশকে পাঁচভাবে বাধাগ্রস্থ করে। প্রথমত, অনেকে শারীরিক ইনজুরিতে ভুগেন, বিকলাঙ্গতার-ও শিকার হন, কিংবা দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ ও অতিরিক্ত-অস্থিরতায় ভুগেন। একটি গবেষণা মতে যেসব নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তারা অন্যান্যদের তুলনায় রূগ্ন অথবা দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা বেশি রিপোর্ট করেছেন (Golding, Cooper, & George, 1997)। দ্বিতীয়ত, অনেকে মানসিকভাবে ভুগেন, যেমন, বিষণ্ন মনোভাব, কাজেকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, উদ্বেগ, অথবা নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা। দেখা গেছে যে সেসব নারী তাদের জীবনে কোনো পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্বেগগত মানসিক ব্যাধির সাহায্যের জন্য যান তারা আগেরকার ধর্ষণ অথবা শারীরিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেন (Fierman et al., 1993)। তৃতীয়ত, অনেক নারী বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা কগনিটিভ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, যেমন কোনো কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, ঋণাত্মক চিন্তাভাবনা করা সবসময়, অন্যরা তার সম্পর্কে "খারাপ কিছু ভাবছে" অথবা প্রিয়জনেরা তাকে নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন এই চিন্তায় অস্থির থাকা ইত্যাদি (Valentiner, Foa, Riggs, & Gershuny, 1996)। চতুর্থত, কিছু কিছু নারীর ক্ষেত্রে ধর্ষণ "হিতে বিপরীত" ধরণের আচরণকে জাগিয়ে তোলে, যেমন, অনেকে হিংস্র হয়ে ওঠেন, অসামাজিক আচরণ করেন কিংবা মাদক বা ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। এবং পঞ্চমত, অনেক নারী নতুন ও পুরাতন সম্পর্ক গড়ে তোলা কিংবা টিকিয়ে রাখতে অনিহা বোধ করেন, এবং যৌন সমস্যায় ভুগেন।

এছাড়া ধর্ষণের ফলে অনেকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করেন, কিংবা যৌনাচরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এমন রোগ যেমন এইডস, ভাইরাস ও ব্যক্টেরিয়ার সংক্রামণ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাই উচিত ধর্ষণ পরে মেডিকেল চেক-আপ করা।

অনেক নারীর ক্ষেত্রে যৌনতার প্রতি বিরূপ ধারণা গড়ে ওঠে, এবং তারা তাদের স্বামী কিংবা সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক-সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে সমস্যায় পড়েন বা ভুগেন, এবং অনেকে পরবর্তীতে যৌন-অক্ষমতায় (sexual dysfunction) ভুগেন। সঠিক সাহায্য সহযোগিতা অথবা মানসিক চিকিৎসার অভাবে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, পিটিএসডি ইত্যাদি মানসিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকেন অনেক নারী বছরের পর বছর ধরে (Resick, 1993)। অনেকে আবার (বিশেষ করে কানাডায়) মাদকাসক্ত বা ড্রাগ-আসক্ত হয়ে পড়েন, মাদককে মানসিক ব্যাধির জন্য স্ব-চিকিৎসার (self-medicate) উপায় হিসেবে বেছে নিয়ে।

ধর্ষণ পরবর্তী মানসিক অবস্থা কেমন হবে সেটি নির্ণয় করা জটিল, অনেকগুলো ব্যাপারের উপর নির্ভর করে এটি। আক্রান্ত ব্যক্তির ধর্ষণ-পূর্ববর্তী জীবন কেমন ছিলো, সামাজিক ও আবেগ-গত ব্যাপারে সে আশপাশের নির্ভর করার মতো লোকদের কাছ থেকে কেমন সাহায্য বা ভরসা পাচ্ছে, কী ধরণের প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ইত্যাদি ব্যাপার অনেক প্রভাব ফেলে। সাধারণত, সবার সহযোগিতা পেলে, আক্তান্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত না করলে এবং সঠিক শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা বা হস্তক্ষেপ পেলে অনেকে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেন।

ধর্ষকের বৈশিষ্ট্য: ধর্ষক আসলে কে বা কারা? ধর্ষক কি হিংস্র কোনো বদমাশ কিংবা মাতাল? না কি পাড়ার মোড়ে অথবা চায়ের দোকানে শিস দেয়া মাস্তান ছেলেটা? পাতি নেতার ছেলে? না কি শান্তশিষ্ট কিন্তু লেজবিশিষ্ট কোনো ছেলে? কানাডায় গবেষণা করে দেখা গেছে যে ধর্ষকদের মাঝে আসলেই উনিশ-বিশ আছে। মূলত দুই ধরণের ধর্ষক হয়ে থাকে- মনোবিকারগ্রস্ত (psychopathic) ও অমনোবিকারগ্রস্ত (non-psychopathic) (Brown & Forth, 1997)। যদিও প্রায় সব ধরণের ধর্ষকদের মাঝে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য প্রায় লক্ষ্য করা যায়- নারীদের প্রতি উগ্র আচরণ বা মনোভাব, নারীদের দ্বারা প্রতারিত বা প্রভাবিত হয়েছে এমন ভুল ধারণা নিয়ে চলা, অথবা মনে করা যে জীবনের কোনো না কোনো সংকটময় ঘটনার জন্য একজন নারী দায়ী, বাবা-মায়ের শারীরিক ও বাক ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বড় হওয়া, এবং ছোটবেলায় শারীরিক অথবা যৌনভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া (Malamuth et al., 1993)। ধর্ষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা রিপোর্ট মতে তারা ধর্ষণ করতে তৎপর হয় একাকিত্ব, রাগ, অপারদর্শীতা, অপমান, মানহানি এবং প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি অনুভূতির তীব্রতা থেকে (McKibben, Proulz, & Lusignan, 1994)। কিছু কিছু ধর্ষকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারা নারীদের বন্ধুত্বতা বা সৌজন্যতাকে অন্য কিছুর আমন্ত্রণ হিসেবে ভুল পাঠ করেন, তারা মনে করেন যে সেই নারী অন্য কিছু চায়, অথচ বাস্তবে সেই নারী হয়তো কেবল সামাজিকতার জন্য কথা বলছে বা হাসছে। তবে অনেক ধর্ষকের প্রায় বিভিন্ন সামাজিক অবস্থা বা ঘটনায় কীরকম আচরণ করতে হবে সেই ধারণা থাকে না, আন্তর্সাম্পর্কিক কলাকৌশল জানা থাকে না, আত্মমর্যাদাহীন ও আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে থাকে, এবং তারা অন্যদের প্রতি, বিশেষ করে ধর্ষিতার প্রতি সহমর্মিতা (empathy) অনুভব করে না (Marshall & Moulden, 2001)। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে অন্যদের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করলে-ও তারা শুধুমাত্র আক্রান্ত নারীর প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করে না।

গবেষকদের মতে সব ধর্ষকই কম-বেশি নারীদের প্রতি হিংস্র মনোভাব ও যৌনাকাঙ্ক্ষার কারণে ধর্ষণ করে। McCabe এবং Wauchope (2005) এর মতে চার ধরণের ধর্ষক আছে যারা হিংস্রতা ও যৌনাকাঙ্ক্ষার মাত্রা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন। একদল পুরোপুরি হিংস্রতা ও ক্রোধের কারণে ধর্ষণ করে থাকে, যাদের কাছে যৌনাকাঙ্ক্ষা বড় বিষয় নয়; দ্বিতীয় একদল আছে যারা শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য নারীদের ধর্ষণ করে থাকে, যদিও তারা নিজেরা অক্ষম হতে পারে (যৌনভাবে বা কাজের ক্ষেত্রে); তৃতীয় দল অনেকটা দ্বিতীয় দলের মতোই, তবে তারা তাদের শিকারের প্রতি নমনীয়, কৈফিয়তমূলক, প্রশংসাসূচক আচরণ করে; এবং চতুর্থ দল হচ্ছে যৌনতাড়নার কারণে ধর্ষণ করা দল (সে যৌনাকাঙ্ক্ষা অনেক সময় বিকৃত প্রকারের হয়)। তবে অন্যান্য গবেষকদের মতে এই বিভক্তকরণ পুরোপুরি সঠিক নয়, কিছু কিছু ধর্ষককে উল্লেখিত কোনো দলেই ফেলা যায় না, অবস্থা, সময় ও পারিপার্শ্বিক অনুসারে তাদের ধর্ষণের কারণ ভিন্ন হতে পারে (LeVay & Valente, 2006)।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই ধর্ষক একাধিক ধর্ষণ করে থাকে, অর্থ্যাৎ যে ধর্ষক একবার ধর্ষণ করেছে সে আবার করতে চাইবে বা করার সম্ভাবনা বেশি, এবং অধিকাংশ ধর্ষণই পূর্বপরিকল্পিত। আশি শতাংশ ধর্ষণ হয়ে থাকে আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আশপাশেই অথবা বাড়িতেই; অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটু জনবিরল অথবা জনসমাগম কম এমন জায়গায় ধর্ষণ করা হয় (যেমন- বহুতল ভবনের লিফট বা সিঁড়িতে, এ্যাপার্ট্মেন্ট বা বাড়ির নিরিবিলি অংশে ইত্যাদি)।

সামাজিক প্রেক্ষাপটে, যে সমাজ পারষ্পরিক ঝগড়া ক্যাচাল ইত্যাদির সমাধান হিসেবে হিংস্রতা ও আক্রমণে সায় দেয় সেই সমাজে ধর্ষণের হার বেশি। একটি চমকপ্রদ গবেষণাতে দেখা গেছে যে যদিও অনেক শিক্ষার্থী মত প্রকাশের সময় বলে যে তারা ধর্ষণকে সমর্থন করে না কিন্তু যখন তাদেরকে ধর্ষণের ভিডিও দেখানো হলো এবং সেই ভিডিও এডিটিং করে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হলো যে ধর্ষণের সময় আক্রান্ত নারীটির রাগমোচন বা অর্গাজম হচ্ছে তখন সেই শিক্ষার্থীরা যৌনভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে (Malamuth & Check, 1983)। এই গবেষণা নির্দেশ করে যে যেসব পর্নগ্রাফি বা নীলছবি বা অশ্লীল ছবিতে দেখানো হয় যে নারীরা নিগৃহীত যৌন-সম্পর্ককে উপভোগ করেন সেইসব নীলছবি হয়তো কোনো না কোনোভাবে ধর্ষকামী মনোভাবকে উৎসাহিত করে।

ধর্ষিতা ও ধর্ষকের জন্য মনোচিকিৎসা: ধর্ষণ সংক্রান্ত ব্যাপার অনেকক্ষেত্রে মনোচিকিৎসকদের জন্য শাপে বর, যেহেতু ধর্ষিতা ও ধর্ষক যেকোনো জনই চিকিৎসার জন্য আসতে পারেন, এবং একই ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুই রোগীর জন্য দুই ধরণের চিকিৎসা প্রদান করতে হয়; বিষয়টি নৈতিকতা ও পেশাদারি দিক থেকে জটিল।

ধর্ষকদের জন্য যে মনোচিকিৎসা দেয়া হয় সাধারণ সেইসব চিকিৎসা বিভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে, অনেক সময় অনেক ধরণের চিকিৎসা একই ব্যক্তিকে দেয়া হয়; তবে কী ধরণের চিকিৎসা দেয়া হবে সেটি নির্ধারণ করা হয় ধর্ষক জেল থেকে বের হওয়ার পরবর্তী অপরাধপ্রবণতার হার থেকে। কগনিটিভ (Cognitive) চিকিৎসাকৌশলের ক্ষেত্রে সাধারণত ধর্ষকের চিন্তাধারা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়, যেমন অনেক ধর্ষক মনে করে যে নারীরা ধর্ষিত হতে চায়, এই বিভৎস চিন্তাচেতনাকে পরিবর্তন করা হয়; পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয় নারীদের প্রতি বিরূপ অবমাননাকর মনোভাবের, লোকজন বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়, রাগ নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল শেখানো, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বাড়ানো, এবং মাদক দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা বা মাদকাসক্তি থাকলে তা কমানোর চেষ্টা করা হয়। সাধারণত অনেকে ক্ষেত্রে দলীয় থেরাপিতে এইসব শেখানো হয়, ফলে ব্যক্তি অন্যদের সাথে একাত্মবোধ করতে শেখে এবং অন্যদের কাছ থেকে শিখতে-ও পারে। অনেকক্ষেত্রে ধর্ষকের অস্বাভাবিক যৌনতাড়না থাকলে তা কমানোর জন্য চেষ্টা করা হয় জৈবিক বা শারীরিক চিকিৎসার মাধ্যমে (যেমন- ঔষধ দেয়া)। মেটা-বিশ্লেষণ (meta-analysis; অনেকগুলো গবেষণার ফলাফলকে একত্র করে একটি চিকিৎসা বা পরিবর্তনের সার্বিক প্রভাব কী সেটি নির্ণয়ের জন্য করা গবেষণা বা বিশ্লেষণ) থেকে জানা যায় যে যেসব ধর্ষক কগনিটিভ মনোচিকিৎসা ও শারীরিক চিকিৎসা পুরোপুরি সম্পূর্ণ করেন তাদের মাঝে ধর্ষণ-পরবর্তী অপরাধপ্রবণতা কম লক্ষ্য করা যায়, অর্থাৎ, চিকিৎসায় কাজ হয় (Hanson & Bussiere, 1998)।

অন্য়দিকে, ধর্ষিতার বা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন এমন ব্যক্তির জন্য কানাডার বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ সংকট কেন্দ্র (rape crisis center) ও টেলিফোন হটলাইনের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের-ও এই ব্যবস্থা আছে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারেন এবং যারা সঙ্কটে আছেন তারা পরামর্শ চাইতে পারেন অথবা সাহায্য চাইতে পারেন। ধর্ষণের শিকার যারা তাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনোচিকিৎসকরা সাধারণত সেই নারীর বর্তমান নাজুক সম্পর্কগুলোর দেখভালের উপর নজর দেন, যেমন ধর্ষণের পর থেকে ঘনিষ্ট কারো সাথে (যেমন- স্বামী বা সঙ্গী) সম্পর্ক খারাপ হয়েছে কি না, হলে সেইক্ষেত্রে কী করণীয়, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছে কি না অথবা কী ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন সেটি নির্ণয় করা, তারা সমালোচনা না করে যথেষ্ট আবেগ-সংক্রান্ত সহযোগিতা করছে কি না ইত্যাদি নিশ্চিত করা। যেহেতু অনেকে ধর্ষণের কারণে পিটিএসডি কিংবা বিষণ্নতার ব্যাধিতে পড়ার অনেক ঝুঁকিতে থাকেন মনোচিকিৎসকদের বড় দায়িত্ব হচ্ছে তা রোধ করা।

অনেক ধর্ষিতা ধর্ষণের জন্য নিজেকে দোষারোপ করেন (যেমন- কেনো আমি এই কাজটি করলাম না, কেনো আমি বাইরে গেলাম একা একা), এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে যে আক্রান্ত ব্যক্তি যেনো নিজেকে দোষারোপ না করেন, কারণ তাতে বিষণ্নতা ও অন্যান্য ব্যাধিতে পড়ার ঝুঁকি বাড়েই । চিন্তাসংক্রান্ত-আচরণগত চিকিৎসার (cognitive-behavioral therapy) রূপভেদ্গুলোর মধ্যে মনোবিজ্ঞানি Patricia Resick এর cognitive processing therapy অনেক কার্যকরি এবং গবেষণা দ্বারা যাচাইকৃত (Vickerman & Margolin, 2009)। এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারীর যেসব চিন্তাধারা আত্মঘাতী (যেমন, ধর্ষণের জন্য ধর্ষককে নয় বরং নিজেকে দায়ী করা) সেইসব চিহ্নিত করে পুনর্গঠন করা হয়, এবং ধর্ষণের স্মৃতিসমূহ রোমন্থন করা হয় উদ্বেগ দুশ্চিতা কমাতে।

অনেকক্ষেত্রে ধর্ষণের রিপোর্ট করা হলে-ও বিচার পাওয়া যায় না, কিংবা আইনিপদক্ষেপ যথেষ্ট হয় না (যেমন- সাম্প্রতিককালের তনু ধর্ষণ ও হত্যা)। প্রায় পাঁচ লাখের-ও বেশি আক্রান্ত নারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে সাধারণত তিনটি কারণে ধর্ষণ রিপোর্ট করতে দ্বিধাবোধ করেন তারা:
১. ধর্ষণ-সংক্রান্ত বিষয়াদিতে অনেকক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর ব্যাপার জড়িত থাকে
২. তারা ধর্ষক বা তার পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আরো হুমকি বা প্রাণনাশের আশংকা করেন
৩. তারা মনে করেন যে পুলিশ অথবা বিচার বিভাগ উদাসীনতা দেখাবে, যথেষ্ট পদক্ষেপ নিবে না, কিংবা তাদেরকেই নাজেহাল করতে পারে (Wright, 1991)।

খুব অল্পসংখ্যক ধর্ষণের কথা রিপোর্ট করা হয়। যেমন, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ ধর্ষণের কথা রিপোর্ট করা হয় এবং সেই সব রিপোর্টের দশ ভাগের এক ভাগের বিচার হয় (McGregor, Du Mont, & Myhr, 2002)। ধারণা করছি বাঙলাদেশ অবস্থা আরো খারাপ। অথচ এই অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। তা হলে ধর্ষক ও ধর্ষণকেই উৎসাহ করা হয়।

ধর্ষণ রোধে কী করা যায়?: ১. যেহেতু অধিকাংশ ধর্ষণের জন্য পুরুষরাই দায়ী, তাই নারীদের প্রতি তাদের মনোভাব আচরণ চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে হবে। এরজন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষাদান ও যৌনশিক্ষা দান। 'যৌনতায় প্রয়োজন সম্মতি' এই নীতি মনে রাখতে হবে ধর্ষকামী পুরুষদের। বাঙলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যৌনশিক্ষা বলতে কিছু নাই, অথচ যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক- সঠিক যৌনশিক্ষা পেলে যৌনরোগ প্রতিরোধ, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ, কিশোরীদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ ইত্যাদি ছাড়া-ও সুষ্ঠ যৌনচর্চার ব্যাপারে অবিহিত করা যায়। যৌনশিক্ষা পেলে ছেলেমেয়ে "নষ্ট" হয়ে যাবে এই ধারণা ভুল। যৌনতাকে ইতিহাসের যে সময়ে যে সমাজ দাবিয়ে রেখেছে তারা রক্ষণশীল হয়েছে, শুধু তাই নয়, অন্যান্য অপরাধের হার-ও বেড়ে গেছে, সামাজিক অবস্থায় অস্থিতিশীলতা এসেছে। কারণ, যৌনতা মানুষের আদিম ও প্রাথমিক একটি রিপু, একে দমন করা কিছু নেই, সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন শুধু।

২. নারীরা পুরুষদের সমান- এই চিন্তাকে গ্রহণ করতে হবে। নারীদের প্রতি হিংস্র মনোভাব, কিংবা তাদেরকে নিচু চোখে দেখার চর্চা বন্ধ করতে হবে।

৩. শিশুদের প্রতি যেকোনো ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, তা না হলে তারা বরং মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়, এবং বড় হয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। সব শিশুর জন্য সুষ্ঠ স্বাভাবিক পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

৪. ধর্ষকদের চিহ্নিত করতে হবে। আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত। এবং তাদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা-ও করতে হবে। তা না হলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।

৫. ধর্ষণ রোধের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন- ইন্টারভেনশনের ব্যবস্থা, ধর্ষণবিরোধী জনমত তৈরি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা (বিশেষত, যেসব এলাকায় নারীরা অধিক রাতে কাজ করে বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা)।

এই উল্লেখিত পদক্ষেপই শেষ নয়, বরং সূচনা। ধর্ষণ রোধের দায়িত্ব আপনার, আমার, সকলের। ধর্ষিতাকে নয়, ধর্ষণকে ঘৃণা করুন।

তথ্যসূত্র

Ali, N., Akhter, S., Hossain, N., Khan, N. T. (2015). Rape in Rural Bangladesh. Delta Med Col J. ;3(1). 31-35.

Brown, S. L., & Forth, A. E. (1997). Psychopathy and sexual assault: static risk factors, emotional precursors, and rapist subtypes. Journal of consulting and clinical psychology, 65(5), 848.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ