এই ব্লগটি সন্ধান করুন

জ্বীন-ভুত বিষয়ক একটা লাইভ ভিডিওর রিভিউ, এবং প্রাসংগিক কিছু আলোচনা



গভীর রাতে, জংগলের ভিতরে, জ্বীন-ভুতের সাথে একেবারে মুখোমুখি ক্লোজ এনকাউন্টারের একটা ফেসবুক লাইভ ভিডিও,



"Ghost Hunter Investigator" পেজ থেকে পোস্ট হয়েছে গত পরশুদিন।
ভিডিওটি মাত্র ৩৬ ঘন্টার মধ্যে ৮ লক্ষ+ ভিউ, ২৮ হাজার+ রিয়েকশন, ৫০ হাজার+ কমেন্ট এবং ৫ হাজার+ শেয়ার হয়েছে।
.
বাকি অংশ পড়ার আগে, ভিডিওটির অল্প কিছু অংশ দেখে নিতে পারলে ভালো। সম্পুর্ন ভিডিও ১ ঘন্টা ১৪ মিনিটের। বিল্ড আপ সহ মুল ঘটনা গুলি দেখতে চাইলে, ২০-৪৫ মিনিট পর্যন্ত, আর সরাসরি জ্বীন এনকাউন্টার পার্ট থেকে শুরু করতে চাইলে, ৩৩-৪২ মিনিট পর্যন্ত। সাউন্ডসহ কথা বুঝে দেখলে ভালো।
ডিসক্লেইমারঃ ১৮ বছরের নিচে অথবা বড়রা যারা একটুতেই অনেক বেশি ভয় পান, তারা এড়িয়ে যান দয়া করে, অযথা রিস্ক নিয়েন না।
ভিডিওটির লিংকঃ
উল্লেখিত অংশটুকু দেখা শেষ হলে, লেখার বাকি অংশ পড়ুন। কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা শেষে, আমি ভিডিওটির একটা সহজ ব্যাখ্যা দিতে চাই।
.
অনেক প্যারানরমাল কেস স্টাডি ও পরিচিত সার্কেলে কিছু ঘটনা থেকে জানি, এগুলি প্রায় সবই মনের ভুল, মিথ্যে বা সাজানো ঘটনা, প্রতারণা।
অতীতে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে বহু জ্বীন হাজিরের ঘটনা ঘটত, এমনকি এখনো কিছু মানুষ অনেক সমস্যার সমাধানে জ্বীনের শরণাপন্ন হন। টিন এজ বয়সে আমার নানার গ্রামে, জ্বীন হাজিরের এক ঘটনার সময় উঠানে দাঁড়িয়ে জ্বীনের কথা আমি শুনেছি, মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতে দেখেছি। তখন পুরো নিশ্চিত ছিলাম না, তবে এখন বুঝি, সেটাও প্রতারণা ছিলো।
মানুষকে জ্বীনেরা ফোনও করে, টাকাপয়সা দাবী করে। আমি ও আমার খালাত ভাই শিশির, ফোনে একবার জ্বীনের সাথে কথাও বলি বেশ কিছুক্ষন ।
এভাবে মানুষের বিশ্বাসকে পুজি করে, কিছু মানুষ নিজেদের রুজিরোজগার করেন, বা খুনের মত অপরাধ মুলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন। তবে মানুষ আগের চেয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠায়, এসব জ্বীন ব্যবসা আগের তুলনায় কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে, তবে এখনো ঘটে।
বাংলাদেশে জ্বীন বিষয়ক অতি-সাম্প্রতিক কিছু খবরের লিংক।
জ্বীনের বাদশাহর প্রতারনা-


মাদ্রাসার ১৭টি মেয়ের উপর জ্বীনের আছর-
জ্বীন ছাড়ানোর নামে পানিতে চুবিয়ে হত্যা-
জ্বীন-পরীর চিকিৎসা করতে গিয়ে মেয়ের হাতে কবিরাজ মায়ের মৃত্যু-
সাধারনত, জ্বীন বিষয়ক ও পরবাস্তব ঘটনা গুলির উল্লেখযোগ্য পরিমান, দক্ষিন বঙ্গ ও তার আশেপাশের জেলা গুলোতে ঘটে।
.
জ্বীন-পরীর আছর পড়েছে, এরকম মানুষেরা আসলে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। সিজোফ্রেনিয়ায় মানুষ তার আশেপাশের বাস্তবতার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, হ্যালুশিনেশন, ডিলুশ্যন থেকে শুরু করে বিভিন্ন লক্ষন দেখা দেয়। কুসংস্কার বা ভুল জ্ঞানের জন্য অনেকে এরকম রুগীদের, মারপিট, অত্যচার করে শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি বা মেরেও ফেলেন।
সিজোফ্রেনিয়ার পুরোপুরি কিউর সম্ভব নয়, তবে সিম্পটম গুলি সফলভাবে ম্যানেজ করা সম্ভব। মেন্টাল হেলথ স্পেশালিষ্টদের সাথে যোগাযোগ ও ট্রিটমেন্ট করালে, অবস্থার উন্নতি হয় রোগীর, এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসা সম্ভব।

বাংলায় সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষন, করনীয়, ও যোগাযোগের তথ্য সম্বলিত একটা লেখা-
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। ছবি : রেড অরবিট
সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ ও করণীয়





.
জ্বীন-ভুত হাজির করা, প্যারানরমাল ঘটনা, সাইকিক পাওয়ার, ব্লাক ম্যাজিক- এসব করে দেখাতে পারলে, লিজেন্ডারি James Randy ফাউন্ডেশন ১৯৭০ থেকে মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষনা করে রেখেছে। বলা বাহুল্য, এখনো কেউ সেটা নিতে পারেনি। কলকাতার প্রবীর ঘোষও ৫০ লক্ষ রুপি পুরস্কার ঘোষনা করে রেখেছেন।

James Randi, founder of the James Randi Educational Foundation


যারা চেস্টা করেছে এই অর্থ পুরস্কার নেওয়ার, তাদের ভুংভাং জারিজুরি ধরা পড়েছে। আর সত্যিই প্যারানরমাল ব্যাপার স্যাপার করে দেখাতে পারেন যারা, তাদের সম্ভবত, ওইসব মিলিয়ন ডলারের লোভ নেই একেবারেই। বরং, সাধারন মানুষের কাছ থেকে অল্প অল্প করে হাজার টাকা বা লক্ষ টাকা উপার্জনই তাদের মুল লক্ষ্য, তাই জেমস র্যান্ডি বা প্রবীর ঘোষের লোভনীয় অর্থ পুরস্কারটা তারা নেওয়ার চেস্টাটাও করতে চান না ।
.
এবারে লেখার প্রথমে, আলোচিত ভিডিওটি কুইক রিক্যাপ ও ডিবাংক করার চেস্টা করা যাক।
রি-ক্যাপঃ শুরুতে, জ্বীন বারবার ঢিল ছুড়ে, ডান-বাম দিয়ে শব্দ করে হেটে বা দৌড়ে যেতে থাকে। এরপর, হটাৎ গাছ নাড়াতে শুরু করে সবার সামনেই। সবাই ভয় পেয়ে, দোয়া-দরুদ পড়া অবস্থাতেই, জ্বীন রেগে গিয়ে, তাদের একজনকে (মিলন) শুন্যে তুলে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করে, সৌভাগ্যক্রমে মিলন গাছে আটকে যায়, এবং অন্যরা কোনোক্রমে জ্বীনের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়। এরপরও চলতে থাকে গাছ ঝাকানো ও ঢিল মারা পর্ব।
ডিবাংকঃ ভিডিওটি একটু আনাড়ি টাইপ হলেও, প্রথম দেখাতে, ঠিক বোঝা কঠিন, গাছ কিভাবে নাড়ানো হচ্ছে । আর যদি নিজেকে ভয়ও গ্রাস করে, তাহলে আরই বোঝা যাবে না।
৩৪ঃ০২ অংশের গাছ ঝাকানোতে বল প্রয়োগ ও প্রয়োগকৃত বলে সৃষ্ট ঝাকি গাছের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার ডাইরেকশন দেখে, যে তথ্যটুকু ধরা যায়- সরু গাছ দুটিকে উপড় থেকে কেউ ঝাকাচ্ছে না, বরং শক্তভাবে গোড়ার দিকে গ্রিপ করে ঝাকাচ্ছে কেউ, অথবা গোড়ায় দড়ি বাধা আছে, কেউ দূর থেকে টানছে দড়ি ধরে, তাই গাছ শব্দ করে নড়ছে।
কিন্তু উপস্থিত টিমের মতে, জ্বীনেরা নাকি গাছের উপর দিয়ে চলাচল করছিলো, আর উপর থেকেই নাকি কামডা করতেছিলো, মানে নাড়াচ্ছিলো আর কি । সবাই উপরে তাকায়, ক্যামেরাও সেদিকে ফোকাস হয়। কিছু একটা দেখেও না দেখার চেস্টা, কারন গাছ নড়ার স্টাইল দেখে, তাদের ইন্সট্যান্ট ফোকাসটা আগে গাছের নিচের দিকে যাওয়ার কথা।
ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ৩৩ঃ৫৭ এর দিকে গাছ নড়ার আগেই, কি যেন একটা নড়ছিলো গাছের গোড়ায় অন্ধকারে, ক্যামেরায় আংশিক দেখা যায় সেটা। হয়ত কোনো প্রানী হবে, কারন চোখ চিক চিক করার মতও দেখা যায় একটু। তাহলে কি, তাদের সামনে জলজ্যান্ত একটা প্রানী বসে আছে, অথচ তারা সেটা না দেখে উপড়ে তাকিয়ে বলছে, কামডা উপড় থেকে হইছে ?
মেইন ধরাটা খেয়েছে ওখানেই। আমি, রাতের বেলা ফোনে দেখছিলাম এই ভিডিও। রাতে ফোনের ব্রাইটনেস সর্বনিম্ন রাখি। ফুল ব্রাইটনেস দিয়ে দেখার পরে, ঘটনা ক্লিয়ার হতে শুরু করে।
ওদের জ্বীনটা আসলে, একটা কালো রঙের বানর অথবা সমগোত্রীয় প্রানী, বানরের হাতের গ্রিপ মানুষের মতই। খুব সম্ভব, ওটাকে আগে থেকেই ট্রেইনড আপ করা হয়েছে, গাছ ঝাকাতে হবে। ঘটনার আগে, ক্যামেরা যখন গাছের উপর দিকে ফোকাস করা ছিলো, কালো বানরটি ক্যামেরার পিছনে থাকা টিমের মাঝখান থেকে হেটে এসে সুন্দরভাবে গাছের গোড়ায় গিয়ে বসে। বানর হেটে আসার পুরোটা সময় সে ক্যামেরার ফোকাসের বাইরে ছিলো। বানরটি গাছের গোড়ায় বসে, বসদের দিকে মাথা ঘুড়িয়ে ইশারার অপেক্ষায় থাকে। ওই সময়, বানরটি যখন মাথা ঘুড়িয়ে তাকাচ্ছিলো, মানে গাছ ঝাকানোর কয়েক সেকেন্ড আগে, বানরটির মাথা ও মুখ অন্ধকারে নড়তে দেখা যায়, ইশারা পেয়ে সে জ্বীন হয়ে যায় । ওই দফায় গাছ ঝাকানোর পরেও বানরটি ওখানে কিচ্ছুক্ষণ ছিলো। পরবর্তীতে আরো কয়েকবার ঝাকিয়েছে গাছ।
(এই পোস্টের সাথে বানরটির অবস্থান মার্ক করে, একটা স্ক্রিনশট দিয়েছি। ফোনের ফুল ব্রাইটনেস সেট করে, তারপর ছবিটা দেখুন, আপনিও বানরটা দেখতে পাবেন)
এরপর জ্বীনের অনবরত ঢিল মারা, মিলনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেস্টায় আর কোন রহস্যই থাকে না, সবই কাচা অভিনয়। মিলনকে জ্বীনের শুন্যে তুলে টেনে নেওয়ার শুরুটাও হয় ক্যামেরার ফোকাসের বাইরে থেকে। আর শেষের দিকে, শেয়ালের ডাক অরিজিনালই নাকি রেকর্ডেড, সেটার আসলে গুরুত্ব নেই।
আপডেটঃ Baba Expose নামক পেজটির মতে ওটা বানর নয়, ওটা ওদের আরেক টিম মেম্বারের কাজ।
এই লেখাটি, জ্বীনের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তার উপর নয়। বরং জ্বীন-ভুত সম্পর্কিত যত গল্প আমরা শুনি, তার প্রায়ই সবই ফেইক, বা সহজেই ডিবাংক করা যায়, সেটা বলা হয়েছে। এরকম কিছু সামনা সামনি দেখলে আমরা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই, ওল্ড ব্রেনের লিমবিক সিস্টেমের অন্তর্গত এমিগডালা অংশটি একটিভ হয়ে ওঠে, তাই আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি আর কাজ করে না। যুক্তি-বুদ্ধির ব্যবহার হয় ব্রেইনের ফ্রন্টাল করটেক্স পার্টে। আর লিমবিক সিস্টেম/এমিগডালা কোর ইমোশন গুলি নিয়ন্ত্রন করে, যেমন প্রচন্ড ভয়, নির্ভেজাল আনন্দ-সুখ, প্রচন্ড রাগ, সারভাইভাল রেসপন্স ইত্যাদি। এসব ইমোশন যখন একটিভেট হয়, ফ্রন্টাল করটেক্স থেকে ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর এবিলিটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
লিমবিক সিস্টেম-

The limbic system is a complex set of structures that lies on both sides of the thalamus, just under the cerebrum.  It includes the hypothalamus, the hippocampus, the amygdala, and several other nearby areas.  It appears to be primarily responsible for our emotional life, and has a lot to do with the formation of memories.  In this drawing, you are looking at the brain cut in half, but with the brain stem intact.  The part of the limbic system shown is that which is along the left side of the thalamus (hippocampus and amygdala) and just under the front of the thalamus (hypothalamus):



আর ওই "Ghost Hunter Investigator" পেজের অন্য কোন লাইভ আগে দেখিনি, এটাই প্রথম। সম্ভবত ওদের কাজই হচ্ছে, মানুষের জ্বীন-ভুতে বিশ্বাস ও ভয়কে পুজি করে, এরকম লাইভ করা, এবং লক্ষ লক্ষ ভিউ, লাইক, শেয়ার কামানো। নিজে ভয় পাওয়া, এবং অন্যকে ভয় পাইয়ে দেওয়াতে অনেক মানুষের আসক্তি আছে। আবার যদি পরিচিতি বা কোনো মুনাফা করা যায় এটা থেকে, তো মন্দ কি?
.
অনেকেই এই ভিডিওটা বিশ্বাস করবে বা করেছে। তারা হয়, বানরটিকে দেখতেই পাবে না, অথবা দেখলেও, তারা ভাববে, ওটাই জ্বীন, বানরের রুপ নিয়ে এগুলো করেছে। যে মনে প্রানে বিশ্বাস করবে ওটা জ্বীনেরই কাজ, তার মন বারবার ওটাকে জ্বীনই প্রমান করতে চাইবে। কারন তার কাছে, জ্বীনে মেলায় বস্তু, বানরে অল্প দূর...থুক্কু বহুদূর..

ব্লগটি লিখেছেন...

                                           Rokonuzzaman Tuhin



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ