সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আরো একটি সমস্যা


রোহিঙ্গা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এক স্থায়ী সমস্যার নাম। এখনকার পরিস্থিতিতে এটাকে শুধু সমস্যা না বলে মহাবিপদ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। স্থায়ী সমস্যা বলছি কারণ, কেবল এখান থেকে দুই বছর আগেই এই সংকটের সূত্রপাত হয়নি। এটা বেশ পুরনো সমস্যা, এবং অতীতে বেশ কয়েকবার এমন ভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকেছে কিংবা পরিকল্পিতভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যত রোহিঙ্গা অতীতে এসেছে, তাদের একজনকেও আমারা মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারিনি।


দুই বছর আগে যখন রোহিঙ্গাদের জন্য বর্ডার উন্মুক্ত করে দেয়া হলো, তখন কিন্তু আমরা সকলেই জানতাম যে, এদের আর আমরা ফেরত পাঠাতে পারবোনা। একথা আপনার আমার মত সাধারন মানুষ যেমন জানতাম, আমাদের সরকার প্রশাসন, আমাদের বুদ্ধিজীবি কিংবা যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো আছে তারাও সবাই জানত। রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের পরিকল্পনার কথাও আমরা জানতাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে করা তাদের এই মাস্টারপ্ল্যান সম্পর্কে আমরা সম্যক অবহিত ছিলাম। তাহলে এত কিছু জেনে-শুনে-বুঝে রোহিঙ্গাদের জন্য আমরা আমাদের বর্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম কেন?

অনেকে বলবেন উন্মুক্ত না করে দিয়ে আমাদের উপায় ছিল না। আমি ভাবছি উন্মুক্ত না করে দিলে আমাদের কি সমস্যা ছিল! মিয়ানমারের ভূখন্ডের মধ্যে যা কিছুই ঘটত, তার দায় নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের ছিলনা, সে দায় মিয়ানমারের ছিল। তা নিয়ে যে কোন সমস্যা তৈরি হলে, সেটা ছিল মিয়ানমারের সমস্যা। মিয়ানমারের এই আভ্যন্তরীণ সমস্যা, সেধে আমরা নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নিলাম কেন? মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কি জোর করে এদের বাংলাদেশ ঢুকিয়ে দিত। তা করতে চাইলে তাদেরকে বাধা দিতে আমরা কি অপারগ ছিলাম! আমি মনে করি আমরা মোটেও অপারগ ছিলাম না, আর ঐ রকম পরিস্থিতিতে সীমান্তে সীমিত যুদ্ধ হলেও এখনকার পরিস্থিতির চাইতে সেটা ভালো ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার সবথেকে শক্তিশালী এবং উল্লেখযোগ্য কারণ হলো আমাদের মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ। এবং এই ধর্মীয় অনুভূতির কারণেই সব জেনে বুঝে, এই বিপদ আমরা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়েছি।


৭১ সালে  আমাদের ৩০ লক্ষ লোককে যারা হত্যা করেছিল তারা কি মুসলিম ছিল না ? আমাদের ২ লক্ষের অধিক মা বোন যাদের হাতে ধর্ষণ হয়েছিল, তারা কি মুসলিম ভিন্ন অন্যকিছু ছিল ? ইতিহাসের সবথেকে বর্বরতম গণহত্যা কি আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের উপরে সংগঠিত করেনি ? এত ত্যাগ-তিতিক্ষা রক্তের বিনিময়েও কিন্তু আমাদের এই শিক্ষা হয়নি যে, এই মানসিক ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের আসলে কোন বাস্তবতা নেই। মুসলিম বলে পৃথিবীর কেউ আমাদের খাতির করে না। প্রতিদিন আরব থেকে দলে দলে ধর্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে আমাদের মা-বোনেরা দেশে ফিরছে, এসব আমরা চোখে দেখতে পায় না! আমাদের দেশ থেকে কাজ করতে যাওয়া মানুষ সেখানে মুসলিম বলে কি কোন বিশেষ সুবিধা পায়? নাকি তাদের সাথে যে আচরণ তারা করে, তা কুকুর বিড়ালের সাথেও মানুষ করে না। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র এখনো এই অন্ধ অর্বাচীন দর্শন নিয়ে পড়ে রয়েছি। আমরা যদি ধর্মীয় চিন্তার বাহিরে যেয়ে প্রথমেই নিজেদেরকে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে ভাবতাম, তাহলে এই সমস্যা আজকে তৈরি হতেই পারে না।


কিন্তু এখন প্রশ্ন করি, সেই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ দুই বছরের মধ্যে কপূরের মত উবে হারিয়ে গেল কেন! যে রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদেরকে আমরা নিজেরা একবেলা না খেয়ে খাওয়াতে চেয়েছিলাম, সেই ভালোবাসা আর আদিখ্যেতা আজ গেল কোথায়?

এখন সেখানে আশ্রয়দাতা বাঙালিদেরই টেকা দায় হয়ে পড়েছে। আমাদের পাহাড় জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে। পুরো এলাকায় মরণঘাতী রোগের আশঙ্কা আর মাদকের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছে। তাদের হাতে স্থানীয়রা খুন হচ্ছে। স্থানীয়দের তারা এখন হুমকি দিতে শুরু করেছে বাড়িঘর দখল করে নেওয়ার। সেই সাথে পুরো অঞ্চল জুড়ে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেখানে শতশত মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে, হেফাজতের নেতারা প্রতিরাতে সেই সমস্ত মাদ্রাসা মসজিদে যেয়ে ওয়াজ নসিহত করতে শুরু করেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এবং সেই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ এতটাই উবে গেছে যে, আমাদের মধ্যে ৫% লোকও এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের প্রতি আর সহানুভূতিশীল নয়।


কিন্তু এখন আর কেঁদে-কেটে চিৎকার করে কোন লাভ নেই। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমরা চাইলেই এখন তাদের জোর করে মিয়ানমারে পাঠিয়ে দিতে পারব না। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কি বলবো, বাংলাদেশ তাদের কাছে মন্দের ভালো। অন্তত তাদের এদেশে কেউ ব্রাশফায়ার করে মারবে না, এই নিশ্চয়তা তাদের রয়েছে। অথচ তাদের নিজের ভূখণ্ডে সেই নিশ্চয়তা এখনো তৈরি হতে পারেনি, এখনো তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতিও মেলেনি।

অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে মূল জনসমষ্টির সাথে মিশিয়ে দেয়ার। আবার কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন নাগরিকত্ব দিয়ে দেশের মধ্যে ঢুকিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে দেয়ার, কেননা বসিয়ে বসিয়ে কতকাল তাদের আমরা খাওয়াতে পারব! কিন্তু এই সমস্ত কিছু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনো আসেনি। আর এই ধরনের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অর্থই হবে মিয়ানমারের দাবিকে মেনে নেয়া। আর তখন রাখাইনের আর যে সমস্ত রোহিঙ্গা রয়েছে তাদেরকেও বাংলাদেশ ঢুকিয়ে দেয়ার অবাধ সুযোগ তৈরি হবে‌।


এখন কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা এবং ধৈর্য ধরা ছাড়া আপাতত কোনো পথ নেই। তাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমাদের অব্যাহত রাখতেই হবে। কিন্তু যেহেতু উখিয়া কক্সবাজার এলাকায় পরিবেশগত এবং মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ভাসানচরে তাদেরকে স্থানান্তরিত করা যায় কিনা সেটা দেখা যায়। কিংবা রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোকে যেকোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যায়, যাতে করে তারা ওই নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাহিরে আসতে কিংবা বহিরাগত কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে।
লিখেছেন-আবু জাহেদ। অনলাইন ব্লগার
↑PREVIOUS-সাপ্তাহিক ধর্মীয় ব্যাঙানিক প্রশ্ন ১ম পর্ব

NEXT-আজকের এই দিনে সমকামীদের জন্য ভারতে ঐতিহাসিক রায়

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জাতীয়তাবাদ আরেকটি ধর্ম বই

বাংলাদেশীরা ধর্মভীরু। ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও জাতীয়তাবাদ নামক ধর্মগুলোর প্রতি বাঙ্গালীর দুর্বলতা নতুন কিছু নয়। আমরা যারা মুক্ত-চেতনাকে প্রয়োজনীয় মনে করি, যুক্তিকে ধর্মের ওপরে স্থান দেই তাদের অনেকেই ধর্মের মতই সামনে আসা অন্যান্য প্রতিটি ধারনা ও প্রস্তাবনাকেই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাই, খতিয়ে দেখতে চাই। বা দদূএকটি রূপ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম হিসাবে মানুষের দলবদ্ধ সমাজব্যবস্থার দ্বিতীয় বড় চালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রস্তরযুগে আরো একটি ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল। মানুষেরা নিজেদের গ্রাম বা নগরকে কেন্দ্র করে একটি সামষ্টিক পরিচিতি অনুভব করে শুরু করেছিল। বোধ করি তখন থেকেই মানুষের দলবদ্ধতার তৃতীয় চালক জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক যাত্রা শুরু। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদ নানান চেহারায় দলবদ্ধতার সবচাইতে শক্তিশালী চালক হিসাবে বিদ্যমান। একটি নৃগোষ্ঠী যখন পুঁজিবাদী হতে শুরু করে, যখন সে একটি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র গঠন করে তখনই সে একটি জাতিতে পরিণত হয়। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ আমাদের দেশের রাজনীতিতে কাছাকাছি আছে ইতিহাসের শুরু থেকে। মহাভারত থেকে আজকের খালেদা-হাসিনার রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ একে অন্যের হাত...

গাজওয়াতুল হিন্দ

গাজওয়াতুল হিন্দকে বর্তমান বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল শ্রীলংকার জিহাদীরা তাদের মনে আটকে রেখেছে। এই বিষয়ে নানা মতাভেদ থাকলেও সকল মুসলিম জিহাদীরা মনে করে বা আ শা করে যে ইসলাম সারা পৃথীবিতে এই জিহাদের মাধ্যামে প্রতিষ্টা হবে। তারা এটাকে মর্যাদার্পূণ জিহাদ বলে মনে করে। ইসলামের ভিত্তির অন্যতম হলো জিহাদ। ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালীন প্রচুর যুদ্ধ করা এবং হত্যার পরেই মানুষ ভয়ে ইসলামকে গ্রহন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ভায়রাস বলা হয় ইসলামকে। এই ভায়রাস আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে গাজওয়াতুল হিন্দকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে জিহাদীরা তাদের দলে লোক বেসি করার জন্য অনলাইনে সহ নানা জাগাতে ঠিক এই ভাবে মুসলিমদের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে "গাজওয়াতুল হিন্দ বা ভারতবর্ষের যুদ্ধ সম্পর্কে কি আপনি অবগত? আপনি কি কাফের মুশরিকদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত?" ইসলামীষ্ট  জিহাদীরা ঠিক এভাবে চাই যে সারা পৃথিবীতে সবচে’ বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটা হবে হিন্দুস্তান তথা ভারতের হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের যা সমস্থ জ্ঞানি ইসলামি স্কলার এবং আলেম উলামা জানে। মুসলমানদের জন্য এটা খুব বড়  জিহাদ এবং এই জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই...

বাঙালি এবং লেখকের জীবন

লেখকের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত তার পরিবারের স্বীকৃতি।এখানে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে-লেখালেখি যে একটি কাজ,অন্য মতোই একটি কাজের, এবং সেই কাজের জন্য মনোযোগ,সময় এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়-এই বোধটা তৈরী হওয়া।লেখালেখিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে নাই বা ধরা হলো। কিন্তু এটি যে একটি কাজ,এই স্বীকৃতিটা পরিবার থেকে আসা খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বান লেখক শেষ পর্যন্ত যে লেখক হয়ে উঠতে পারে না,লেখক জীবন যাপন করতে পারেন না,লেখালেখির জগত থেকে তাদের যে অকাল বিদায় নিতে হয়,তার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।লেখালেখিকে পারিবারিক ভাবে স্বীকৃতি না দেওয়া।দেশের অন্য সব মানুষদের মতোই বেশির ভাগ পরিবারে লেখালেখি একটি নেহাৎ ই শখের জিনিস।তারুণ্য বা অংকুরোদ্গমী যৌবনে যৌনতার চুলকানিরও পেয়ে বসে আমাদের দেশের মানুষদের।তখন তাদের লেখাকে বাবাহা দেয় বাড়ির ভাবীরা,কাকা-জ্যাঠারা,সহপাঠীরা,বা তার কোন প্রেমিক-প্রেমিকাও।কখনো কখনো এমনকি বাবা মাও।তারা সকলেই অবচেতনে,এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে,এই চুলকানি বেশিদিন থাকবে না।কিন্তু যার ক্ষেত্রে থেকে যায়,অর্থাৎ যে বুঝে যায় যে লেখক হওয়াটাই তার ভবিতব্য,সমস্যাটা তার ক্ষ...