আমি ফাতিমা জান্নাত বলছি।
আমার দশম প্রশ্ন
ক) একজন নারীর খোলামেলা পোষাক কিংবা জীবনযাপন দেখে কারো যৌন অনুভুতি জাগার কারনে ধর্ষন, হত্যা কিংবা ওগুলোকে সাপোর্ট করা কি ন্যায় সংগত?
আজকে ছোট্ট একটা কুইজ দেই আপনাদের:
১৫/১৬ বছর আগে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার সময় চকরিয়া নামক জায়গায় জঙ্গলের ভেতর থেকে কে যেন আমাদের গাড়িতে কয়েকটা পাথর ছুরে মেরেছিল। ড্রাইভারের পাশের গ্লাসটা ফেটে গেলেও ভাগ্য ভালো কেও কোনও আঘাত পায়নি। লোকাল এক পুলিশের থেকে পরে জানতে পারলাম অল্প বয়সি বখাটে ছেলেপুলে জঙ্গলের ভেতর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে গাড়িগুলোতে ঢিল মারে। কে কয়টা নিশানা লাগাতে পারে এটার উপর তারা নাকি টাকার বাজি ধরে। একবারও ভাবেনা পাথরের আঘাতে কেউ মারাও যেতে পারে।
বখাটে ছেলেরা ওদের বখাটে অনুভূতি কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। পরিবেশ, পরিস্হিতিই ওদের এমন বানিয়েছে। আমরা ঐপথ দিয়ে গেলে ওরা তো পাথর মারবেই এতে ওদের কি দোষ? খাবার সামনে দেখলে তো মাছি বসবেই। সিন্দুক খোলা থাকলে চুরি তো হবেই।
তো এর সমাধান কি করা উচিত ছিল-
১) ঐ একমাত্র হাইওয়ে দিয়ে আমাদের কক্সবাজার যাওয়াই বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল?
২) ঐ রাস্তায় চলা প্রতিটি গাড়িকে পুলিশ/ আর্মির বিশাল প্রটেকশান নিয়ে চলা উচিত ছিল?
৩) আমাদের গাড়িগুলোকে টিনের বোরখা দুঃখিত টিনের কাভার পরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল?কিন্তু ড্রাইভারের সামনে তো গ্লাস লাগবেই।
৪) নাকি ঐ ছেলেগুলোকে হাজতে ভরে শাস্তি দেওয়া এবং ঐ এলাকায় আইন কানুন আরও কঠোর করা উচিত ছিল?এবং সবাই মিলে এই ধরনের ছেলেদের বোঝানো উচিত তাদের এই সাময়িক মজায় কারো জীবন পর্যন্ত যেতে পারে?
একজন নারী, একটা ছোট বাচ্চা এমনকি একটা শিশুকেও যদি কয়েকটা মানুষরুপী জানোয়ার নির্দয়ভাবে ধর্ষণ করে, অনেক সময় রক্তাত্ত করে যন্ত্রণা দিতে দিতে হত্যা পর্যন্ত করে আমাদের দেশের কিছু মানুষ( পৃথিবীর সব গালিগুলো আপনাদের উৎসর্গ করলাম) খুব নিয়মিত কিছু ডায়লগ দেয় এবং দিবে। যেমনঃ
মেয়েটা যে খোলামেলা পোশাক পরত, ও ধর্ষিত হবেনা তো কে হবে তাই ধর্ষকের পাশাপাশি ধর্ষিতাও সমানভাবে দায়ী।
খাবার খোলা রাখলে তো মাছি বসবেই।
শেয়াল তো চাইবেই মুরগির স্বাধীনতা।
মেয়ে মানুষ সন্ধার পর একা একা ঘরের বাইরে কেনো যাবে?
পুরুষ মানুষ হল কুকুরের মত। ব্লা ব্লা ব্লা…।
খোলামেলা পোশাকের মেয়েদের দেখে ধর্ষকের যৌন অনুভুতি জাগবেই তাইতো ওরা ছোট ছোট বাচ্চা-শিশু এমনকি হিজাব পরা নারীকেও ধর্ষণ করে।
আজকে মানুষের 'অনুভূতি’ নামক জিনিসটার একটু পোস্টমর্টেম করিঃ
যৌন অনুভুতি ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানসিক এবং শারিরীক অনুভুতি আছে। ক্ষুধার অনুভুতি, দুখ-কষ্ট, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, রাগ-অনুরাগ, ভয়-ভীতি, অপমান-অপদস্হ থেকে শুরু করে ভালোলাগা- ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা, লজ্জা-শরম, আশা-নিরাশা আরো কত কি…..।
আমরা মানুষ, আমাদের মধ্যে এই অনুভুতিগুলো থাকাটা খুব স্বাভাবিক। অনুভূতি থাকাটা কিংবা সৃষ্টি হওয়াটা হয়তো অন্যায় কিছু নয় কিন্তু ঐ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশটা কেমন হওয়া উচিত ওটাই মুখ্য বিষয়।
১. ঘটনা- রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন একা নারীকে খোলামেলা কোন পোষাকে( শাড়ী, সালোয়ার কামিজ, টি-শার্ট স্কার্ট, ফতুয়া জিন্স) দেখলেন?
মেয়েটার দোষ- কেনো সে ওরকম পোষাক পরলো, কেনো সে একা ছিলো।
অনুভূতি- আপনার প্রচন্ড যৌন অনুভুতি/ যৌন লালসা লাগলো।
ফলাফল- সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে ধর্ষন করলেন আপনি। আর যদি ঐ মেয়েটাকে কোনভাবে কাবু করে ধর্ষন করতে না পারেন তখন অন্য কোন নারীকে সুযোগ বুঝে একা পেয়ে ধর্ষন করে ফেললেন। আর কোন নারীকে সুযোগমত না পেলে একটা ছোট বাচ্চাকে এমনকি একটা ছোট্ট শিশুকে ধর্ষন করে আপনার ঐ মহান, পবিত্র যৌন অনুভুতি মেটালেন।
২. ঘটনা- একজন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ( ফেইছবুক, টুইটার) আপনার প্রিয় মতবাদ, প্রিয় রাজনৈতিক দল, প্রিয় বাক্তি কিংবা আপনার বিরুদ্ধেই সমালোচনা করে কিছু কথা লিখল।
অনুভূতি- আপনার প্রচণ্ড রাগ, ঘৃণার অনুভূতি হল।
ফলাফল- আপনি তাকে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিলেন কিংবা মেরেই ফেললেন।
৩. ঘটনা- একটা মেয়েকে দেখে আপনার ভালোলাগার/ ভালবাসার অনুভূতি হল। তাকে প্রস্তাব দিলেন কিন্তু সে প্রত্যাখ্যান করল কারন সে অন্য কাউকে ভালবাসে।
অনুভুতি- আপনার প্রথমে দুঃখের অনুভূতি হয় পরে তা প্রচণ্ড ক্রোধে পরিণত হলো।
ফলাফল- আপনি মেয়েটাকে এসিড মেরে ঝলসে দিলেন।
৪. ঘটনা- সারাদিন কোনও কারনে না খেয়ে আছেন। কিংবা খাবার নাই তাই খেতে পারেন নি। কিংবা রোজা, উপবাস, fasting করেছেন তাই খেতে পারছেন না।
অনুভূতি- প্রচণ্ড ক্ষুধার অনুভূতি। আমার জানামতে ওটাই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টকর শারীরিক অনুভূতি।
ফলাফল- আপনি কারো খাবার চুরি করে খেলেন, কারো খাবার জোর করে কেড়ে নিয়ে খেলেন, দরকার হলে মেরে কারো খাবার ছিনিয়ে নিলেন।
৫. ঘটনা- দোকানে গিয়ে দামি দামি সোনা, রুপা, হীরা দেখে আপনার চোখগুলো চকচক করতে লাগলও কিন্তু ঐ পরিমাণ টাকা নেই।
অনুভূতি- প্রচণ্ড লোভের অনুভূতি হলো।
ফলাফল- দোকান থেকে চুরি করে কয়েকটা আইটেম লুকিয়ে ফেললেন কিংবা দোকানে ডাকাতি করে সব লুট করে নিয়ে আসলেন।
৬. ঘটনা- সামনে নিজের বন্ধুকে দেখলেন বাড়ি, গাড়ী আর কাঁড়িকাড়ি টাকার মালিক হয়ে গেছে। সাথে সুন্দরি বউ, ফুটফুটে বাচ্চা।
অনুভূতি- আপনার ভেতরে ভয়ানক ঈর্ষা হলো।
ফলাফল- বন্ধুর বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ চাইলেন। ঐ টাকার জন্যও দরকার হলে বাচ্চাটাকে কিংবা বন্ধুটাকেই মেরে ফেললেন।
7. ঘটনা- বন্ধুদের পালায় পড়ে ড্রাগস নেওয়া শুরু করলেন। আসক্ত তো হয়ে পড়লেন কিন্তু হাতে অত টাকা নেই।
অনুভূতি- প্রচন্ড নেশার অনুভূতি হল। নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না।
ফলাফল- মায়ের সিন্দুকে রাখা স্বর্ণের হারটা চুরি করে বিক্রি করে দিলেন। আর মা বাবা যদি গরিব হয় নেশার অনুভূতি মেটানোর জন্যও ছিনতাই করলেন এবং ছিনতাই করতে গিয়ে দু একজন মানুষকে খুন করে ফেললেন।
৮. ঘটনা- একজন খুনী তার খুন করার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এক পুলিশকে বিশাল অঙ্কের টাকা ঘুষের অফার দিলো।
অনুভুতি- টাকার নেশা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেশা। ওটাতে অর্থ- বিত্ত, শক্তি, ক্ষমতা সবকিছু হাতের মধ্যে পাওয়ার লালসা নামক অনুভুতি থাকে।
ফলাফল- পুলিশ ভাই ঘুষটা নিলো এবং খুনের মতো মারাত্নক অপরাধকে লুকিয়ে খুনীকে বাঁচিয়ে দিলো।
২নং থেকে ৮নং পর্যন্ত ঘটনাগুলোর অনুভূতির কারনে ফলাফল গুলো আপনাদের কাছে যদি ন্যায় সংগত মনে হয় তবে ১নং ঘটনার অনুভূতির ফলাফলগুলো একদম ন্যায় সংগত।
২নং থেকে ৮নং পর্যন্ত ঘটনাগুলোর অনুভূতির কারনে ফলাফল গুলো আপনাদের কাছে যদি প্রচণ্ড অন্যায় এবং অপরাধ মনে হয় তবে ১নং ঘটনার অনুভূতির ফলাফলগুলো ও প্রচণ্ড অন্যায় এবং অপরাধ।
সবকিছু বিচারের দায়িত্ব আপনাদের বিবেকের উপর ছেড়ে দিলাম।
এবার আমি আমার কিছু মতামত দেই:
যে কোন প্রানীর মধ্যে অনুভুতি নামক জিনিসটা আছে। কিন্তু মানুষ আর পশুর মধ্যে ‘বিবেক, বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা’ নামক কিছু গুণাবলীর বিশাল পার্থক্য আছে।
তাই কোন কিছুর অনুভুতি হওয়াটা হয়তো অন্যায় না কারন চাইলেও ওটা আমরা মাঝেমাঝে নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা। আর ওটাতে কারো ক্ষতি হচ্ছেনা।
কিন্তু অনুভুতির বহি:প্রকাশ যদি কোনও নিরীহ/ নিরপরাধকে শারীরিকভাবে ক্ষতিসাধন করে তবে সেটা অপরাধ। ঘোর অপরাধ। ধর্ষন ঠিক তেমন ই একটি অমার্জনীয় অপরাধ।
কিছু মানুষ পুরুষদেরকে মাছি, শেয়াল, কুকুরের মতো প্রানীর (যাদের ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নেই, যাদের কাছে পেটের ক্ষুধা আর যৌন ক্ষুধাই সব, যাদের মাঝে নীতি নৈতিকতার, ভালোমন্দ বিচারের কোন অনুভূতি নাই) তাদের সাথে তুলনা করে পর্যন্ত একজন ধর্ষকের ‘ধর্ষন' নামক জঘন্য অপরাধকে ন্যায়সঙ্গত বলার চেষ্টা করেন।
একটু তো লজ্জা করেন। আপনাদের এই কথাগুলোর প্রশ্রয়ে এক শ্রেণীর মানুষ দিনদিন আরোও বন্য হয়ে উঠছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার বদলে তারা ভাবছে, যে যে ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা ধর্ষণ এমনকি ধর্ষণের পর নির্দয়ভাবে হত্যা করছে ওগুলো খুব যৌক্তিক।
আমার দৃষ্টিতে একজন সভ্য মানুষ, একজন মানবিক মানুষ সেই ব্যক্তি যে অনুভূতি নামক গুণাবলীগুলো যা অন্যের ক্ষতি করতে পারে ওগুলোকে বিচার-বিবেচনা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। *(Survival, self defense এবং Law & Order এর ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম হতেই পারে)*।
তাই শেষবার বলছি, কোন ঘটনার কারনে আপনার অনুভুতি হওয়াটা হয়তো অন্যায় না কিন্তু সেই অনুভুতির বহি:প্রকাশে যদি কারো ক্ষতিসাধন হয় সেটা অপরাধ।
আর অপরাধীর জায়গা হচ্ছে মামার বাড়ী( হাজত, জেল)।
এই লেখাটা বাংলাদেশের সোহাগি জাহান তনু- সামিয়া আফরিন সায়মা- রুপা খাতুন, পাকিস্তানের জয়নাব আনসারী, ভারতের নির্ভয়া- আসিফা বানু থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রতিটি নারী ও শিশুর জন্য লিখলাম যারা ধর্ষনের মতো পিশাচীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে জীবন হারিয়েছে।
লিখেছেন:ফাতিমা জান্নাত।
আমার দশম প্রশ্ন
ক) একজন নারীর খোলামেলা পোষাক কিংবা জীবনযাপন দেখে কারো যৌন অনুভুতি জাগার কারনে ধর্ষন, হত্যা কিংবা ওগুলোকে সাপোর্ট করা কি ন্যায় সংগত?
আজকে ছোট্ট একটা কুইজ দেই আপনাদের:
১৫/১৬ বছর আগে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার সময় চকরিয়া নামক জায়গায় জঙ্গলের ভেতর থেকে কে যেন আমাদের গাড়িতে কয়েকটা পাথর ছুরে মেরেছিল। ড্রাইভারের পাশের গ্লাসটা ফেটে গেলেও ভাগ্য ভালো কেও কোনও আঘাত পায়নি। লোকাল এক পুলিশের থেকে পরে জানতে পারলাম অল্প বয়সি বখাটে ছেলেপুলে জঙ্গলের ভেতর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে গাড়িগুলোতে ঢিল মারে। কে কয়টা নিশানা লাগাতে পারে এটার উপর তারা নাকি টাকার বাজি ধরে। একবারও ভাবেনা পাথরের আঘাতে কেউ মারাও যেতে পারে।
বখাটে ছেলেরা ওদের বখাটে অনুভূতি কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। পরিবেশ, পরিস্হিতিই ওদের এমন বানিয়েছে। আমরা ঐপথ দিয়ে গেলে ওরা তো পাথর মারবেই এতে ওদের কি দোষ? খাবার সামনে দেখলে তো মাছি বসবেই। সিন্দুক খোলা থাকলে চুরি তো হবেই।
তো এর সমাধান কি করা উচিত ছিল-
১) ঐ একমাত্র হাইওয়ে দিয়ে আমাদের কক্সবাজার যাওয়াই বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল?
২) ঐ রাস্তায় চলা প্রতিটি গাড়িকে পুলিশ/ আর্মির বিশাল প্রটেকশান নিয়ে চলা উচিত ছিল?
৩) আমাদের গাড়িগুলোকে টিনের বোরখা দুঃখিত টিনের কাভার পরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল?কিন্তু ড্রাইভারের সামনে তো গ্লাস লাগবেই।
৪) নাকি ঐ ছেলেগুলোকে হাজতে ভরে শাস্তি দেওয়া এবং ঐ এলাকায় আইন কানুন আরও কঠোর করা উচিত ছিল?এবং সবাই মিলে এই ধরনের ছেলেদের বোঝানো উচিত তাদের এই সাময়িক মজায় কারো জীবন পর্যন্ত যেতে পারে?
একজন নারী, একটা ছোট বাচ্চা এমনকি একটা শিশুকেও যদি কয়েকটা মানুষরুপী জানোয়ার নির্দয়ভাবে ধর্ষণ করে, অনেক সময় রক্তাত্ত করে যন্ত্রণা দিতে দিতে হত্যা পর্যন্ত করে আমাদের দেশের কিছু মানুষ( পৃথিবীর সব গালিগুলো আপনাদের উৎসর্গ করলাম) খুব নিয়মিত কিছু ডায়লগ দেয় এবং দিবে। যেমনঃ
মেয়েটা যে খোলামেলা পোশাক পরত, ও ধর্ষিত হবেনা তো কে হবে তাই ধর্ষকের পাশাপাশি ধর্ষিতাও সমানভাবে দায়ী।
খাবার খোলা রাখলে তো মাছি বসবেই।
শেয়াল তো চাইবেই মুরগির স্বাধীনতা।
মেয়ে মানুষ সন্ধার পর একা একা ঘরের বাইরে কেনো যাবে?
পুরুষ মানুষ হল কুকুরের মত। ব্লা ব্লা ব্লা…।
খোলামেলা পোশাকের মেয়েদের দেখে ধর্ষকের যৌন অনুভুতি জাগবেই তাইতো ওরা ছোট ছোট বাচ্চা-শিশু এমনকি হিজাব পরা নারীকেও ধর্ষণ করে।
আজকে মানুষের 'অনুভূতি’ নামক জিনিসটার একটু পোস্টমর্টেম করিঃ
যৌন অনুভুতি ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানসিক এবং শারিরীক অনুভুতি আছে। ক্ষুধার অনুভুতি, দুখ-কষ্ট, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, রাগ-অনুরাগ, ভয়-ভীতি, অপমান-অপদস্হ থেকে শুরু করে ভালোলাগা- ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা, লজ্জা-শরম, আশা-নিরাশা আরো কত কি…..।
আমরা মানুষ, আমাদের মধ্যে এই অনুভুতিগুলো থাকাটা খুব স্বাভাবিক। অনুভূতি থাকাটা কিংবা সৃষ্টি হওয়াটা হয়তো অন্যায় কিছু নয় কিন্তু ঐ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশটা কেমন হওয়া উচিত ওটাই মুখ্য বিষয়।
১. ঘটনা- রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন একা নারীকে খোলামেলা কোন পোষাকে( শাড়ী, সালোয়ার কামিজ, টি-শার্ট স্কার্ট, ফতুয়া জিন্স) দেখলেন?
মেয়েটার দোষ- কেনো সে ওরকম পোষাক পরলো, কেনো সে একা ছিলো।
অনুভূতি- আপনার প্রচন্ড যৌন অনুভুতি/ যৌন লালসা লাগলো।
ফলাফল- সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে ধর্ষন করলেন আপনি। আর যদি ঐ মেয়েটাকে কোনভাবে কাবু করে ধর্ষন করতে না পারেন তখন অন্য কোন নারীকে সুযোগ বুঝে একা পেয়ে ধর্ষন করে ফেললেন। আর কোন নারীকে সুযোগমত না পেলে একটা ছোট বাচ্চাকে এমনকি একটা ছোট্ট শিশুকে ধর্ষন করে আপনার ঐ মহান, পবিত্র যৌন অনুভুতি মেটালেন।
২. ঘটনা- একজন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ( ফেইছবুক, টুইটার) আপনার প্রিয় মতবাদ, প্রিয় রাজনৈতিক দল, প্রিয় বাক্তি কিংবা আপনার বিরুদ্ধেই সমালোচনা করে কিছু কথা লিখল।
অনুভূতি- আপনার প্রচণ্ড রাগ, ঘৃণার অনুভূতি হল।
ফলাফল- আপনি তাকে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিলেন কিংবা মেরেই ফেললেন।
৩. ঘটনা- একটা মেয়েকে দেখে আপনার ভালোলাগার/ ভালবাসার অনুভূতি হল। তাকে প্রস্তাব দিলেন কিন্তু সে প্রত্যাখ্যান করল কারন সে অন্য কাউকে ভালবাসে।
অনুভুতি- আপনার প্রথমে দুঃখের অনুভূতি হয় পরে তা প্রচণ্ড ক্রোধে পরিণত হলো।
ফলাফল- আপনি মেয়েটাকে এসিড মেরে ঝলসে দিলেন।
৪. ঘটনা- সারাদিন কোনও কারনে না খেয়ে আছেন। কিংবা খাবার নাই তাই খেতে পারেন নি। কিংবা রোজা, উপবাস, fasting করেছেন তাই খেতে পারছেন না।
অনুভূতি- প্রচণ্ড ক্ষুধার অনুভূতি। আমার জানামতে ওটাই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টকর শারীরিক অনুভূতি।
ফলাফল- আপনি কারো খাবার চুরি করে খেলেন, কারো খাবার জোর করে কেড়ে নিয়ে খেলেন, দরকার হলে মেরে কারো খাবার ছিনিয়ে নিলেন।
৫. ঘটনা- দোকানে গিয়ে দামি দামি সোনা, রুপা, হীরা দেখে আপনার চোখগুলো চকচক করতে লাগলও কিন্তু ঐ পরিমাণ টাকা নেই।
অনুভূতি- প্রচণ্ড লোভের অনুভূতি হলো।
ফলাফল- দোকান থেকে চুরি করে কয়েকটা আইটেম লুকিয়ে ফেললেন কিংবা দোকানে ডাকাতি করে সব লুট করে নিয়ে আসলেন।
৬. ঘটনা- সামনে নিজের বন্ধুকে দেখলেন বাড়ি, গাড়ী আর কাঁড়িকাড়ি টাকার মালিক হয়ে গেছে। সাথে সুন্দরি বউ, ফুটফুটে বাচ্চা।
অনুভূতি- আপনার ভেতরে ভয়ানক ঈর্ষা হলো।
ফলাফল- বন্ধুর বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ চাইলেন। ঐ টাকার জন্যও দরকার হলে বাচ্চাটাকে কিংবা বন্ধুটাকেই মেরে ফেললেন।
7. ঘটনা- বন্ধুদের পালায় পড়ে ড্রাগস নেওয়া শুরু করলেন। আসক্ত তো হয়ে পড়লেন কিন্তু হাতে অত টাকা নেই।
অনুভূতি- প্রচন্ড নেশার অনুভূতি হল। নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না।
ফলাফল- মায়ের সিন্দুকে রাখা স্বর্ণের হারটা চুরি করে বিক্রি করে দিলেন। আর মা বাবা যদি গরিব হয় নেশার অনুভূতি মেটানোর জন্যও ছিনতাই করলেন এবং ছিনতাই করতে গিয়ে দু একজন মানুষকে খুন করে ফেললেন।
৮. ঘটনা- একজন খুনী তার খুন করার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এক পুলিশকে বিশাল অঙ্কের টাকা ঘুষের অফার দিলো।
অনুভুতি- টাকার নেশা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেশা। ওটাতে অর্থ- বিত্ত, শক্তি, ক্ষমতা সবকিছু হাতের মধ্যে পাওয়ার লালসা নামক অনুভুতি থাকে।
ফলাফল- পুলিশ ভাই ঘুষটা নিলো এবং খুনের মতো মারাত্নক অপরাধকে লুকিয়ে খুনীকে বাঁচিয়ে দিলো।
২নং থেকে ৮নং পর্যন্ত ঘটনাগুলোর অনুভূতির কারনে ফলাফল গুলো আপনাদের কাছে যদি ন্যায় সংগত মনে হয় তবে ১নং ঘটনার অনুভূতির ফলাফলগুলো একদম ন্যায় সংগত।
২নং থেকে ৮নং পর্যন্ত ঘটনাগুলোর অনুভূতির কারনে ফলাফল গুলো আপনাদের কাছে যদি প্রচণ্ড অন্যায় এবং অপরাধ মনে হয় তবে ১নং ঘটনার অনুভূতির ফলাফলগুলো ও প্রচণ্ড অন্যায় এবং অপরাধ।
সবকিছু বিচারের দায়িত্ব আপনাদের বিবেকের উপর ছেড়ে দিলাম।
এবার আমি আমার কিছু মতামত দেই:
যে কোন প্রানীর মধ্যে অনুভুতি নামক জিনিসটা আছে। কিন্তু মানুষ আর পশুর মধ্যে ‘বিবেক, বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা’ নামক কিছু গুণাবলীর বিশাল পার্থক্য আছে।
তাই কোন কিছুর অনুভুতি হওয়াটা হয়তো অন্যায় না কারন চাইলেও ওটা আমরা মাঝেমাঝে নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা। আর ওটাতে কারো ক্ষতি হচ্ছেনা।
কিন্তু অনুভুতির বহি:প্রকাশ যদি কোনও নিরীহ/ নিরপরাধকে শারীরিকভাবে ক্ষতিসাধন করে তবে সেটা অপরাধ। ঘোর অপরাধ। ধর্ষন ঠিক তেমন ই একটি অমার্জনীয় অপরাধ।
কিছু মানুষ পুরুষদেরকে মাছি, শেয়াল, কুকুরের মতো প্রানীর (যাদের ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নেই, যাদের কাছে পেটের ক্ষুধা আর যৌন ক্ষুধাই সব, যাদের মাঝে নীতি নৈতিকতার, ভালোমন্দ বিচারের কোন অনুভূতি নাই) তাদের সাথে তুলনা করে পর্যন্ত একজন ধর্ষকের ‘ধর্ষন' নামক জঘন্য অপরাধকে ন্যায়সঙ্গত বলার চেষ্টা করেন।
একটু তো লজ্জা করেন। আপনাদের এই কথাগুলোর প্রশ্রয়ে এক শ্রেণীর মানুষ দিনদিন আরোও বন্য হয়ে উঠছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার বদলে তারা ভাবছে, যে যে ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা ধর্ষণ এমনকি ধর্ষণের পর নির্দয়ভাবে হত্যা করছে ওগুলো খুব যৌক্তিক।
আমার দৃষ্টিতে একজন সভ্য মানুষ, একজন মানবিক মানুষ সেই ব্যক্তি যে অনুভূতি নামক গুণাবলীগুলো যা অন্যের ক্ষতি করতে পারে ওগুলোকে বিচার-বিবেচনা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। *(Survival, self defense এবং Law & Order এর ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম হতেই পারে)*।
তাই শেষবার বলছি, কোন ঘটনার কারনে আপনার অনুভুতি হওয়াটা হয়তো অন্যায় না কিন্তু সেই অনুভুতির বহি:প্রকাশে যদি কারো ক্ষতিসাধন হয় সেটা অপরাধ।
আর অপরাধীর জায়গা হচ্ছে মামার বাড়ী( হাজত, জেল)।
এই লেখাটা বাংলাদেশের সোহাগি জাহান তনু- সামিয়া আফরিন সায়মা- রুপা খাতুন, পাকিস্তানের জয়নাব আনসারী, ভারতের নির্ভয়া- আসিফা বানু থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রতিটি নারী ও শিশুর জন্য লিখলাম যারা ধর্ষনের মতো পিশাচীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে জীবন হারিয়েছে।
লিখেছেন:ফাতিমা জান্নাত।
0 মন্তব্যসমূহ
মুক্তচিন্তার সাথে হোক আপনার পথ চলা।