এই ব্লগটি সন্ধান করুন

ধর্ম এবং লিঙ্গ বৈষম্য


পৃথিবীতে সাম্যের বাণী নিয়ে যুগে যুগে এসেছে ধর্ম। ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পৃথিবীর সকল ধর্মবিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাস করেন যে একমাত্র তার ধর্মই সঠিক, অন্যসকল ধর্ম মিথ্যা। যদিও আজপর্যন্ত কোন ধর্ম বলে নাই তোমরা চুরি করো, অন্যায়ভাবে মানুষ খুন করো, অন্যের অধিকার হরণ করো। তবুও এই পৃথিবীতে ধর্মের নামেই সব থেকে বেশী রক্ত ঝরেছে।
সে পাঠাবলি, নরবলি হোক আর ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ হোক ধর্মের নামেই ঝরেছে প্রাণ। অন্যধর্মের মানুষ হত্যা করে আপন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করো এরকম বাণী কোন ধর্মগ্রন্থের কোন পাতায় লেখা আছে কিনা তা আজপর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নাই। আসুন আমরা খুঁজে দেখি পৃথিবীর মানবতাবাদী ধর্মগুলোতে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে।


ইব্রাহীমিয় ধর্মে---
মানুষ সৃষ্টি
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর বংশধরদের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রচারিত ধর্মগুলোকে একসাথে বলা হয় ইব্রাহিমীয় ধর্ম। ইসলাম, খ্রিষ্ট ধর্ম, ইহুদি ধর্ম এগুলো সবই ইব্রাহিমীয় ধর্ম। প্রতিটি ইব্রাহিমীয় ধর্ম পুরুষ এবং নারী সৃষ্টির ব্যাপারে আদম এবং হাওয়া (ইভ) এর গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ প্রথমে মাটি থেকে তৈরী করেন আদম (আঃ) কে। আদমের বুকের পিঞ্জিরা দিয়ে তৈরী করেন বিবি হাওয়া কে। তাহলে আল্লাহ রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ কিভাবে তৈরী করেন? নারী পুরুষের পাশাপাশি রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ কিভাবে সৃষ্টি করা হলো এই বিষয়ে পৃথিবীর কোন ধর্মেই আলোচনা করা হয়নি।


ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত লিঙ্গ---
শান্তি এবং সাম্যের ধর্ম ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরিত লিঙ্গদের মুখান্নাতুন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবিতে মুখান্নাতুন বলতে মেয়েদের মত আচরণকারী পুরুষদেরকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু শুধুমাত্র মেল টু ফিমেল ট্রান্সসেক্সুয়ালদের বোঝানো হয় তাই আরবি মুখান্নাতুন হিব্র্যু সারিস বা ইংরেজী ইউনুখ এর সমার্থক শব্দ নয়। পবিত্র আল কোরআনের কোথাও মুখান্নাতুন সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। কিন্তু হাদিসে মুখান্নাতুনের উল্লেখ পাওয়া যায়।

আন নববী বর্নিত হাদিস থেকে জানা যায়, একজন মুখান্নাতুন হচ্ছে সেই পুরুষ যার চলাফেরায়, চেহারায় এবং কথাবার্তায় নারী আচরণ বহন করে। তারা দুই প্রকারেরঃ প্রথম প্রকারের হচ্ছে তারাই যারা এই ধরণের আচরণ ইচ্ছাকৃতভাবে করেনা এবং তাদের এই ব্যবহারে কোন দোষ নেই, কোন অভিযোগ নেই, কোন লজ্জা নেই যতক্ষন পর্যন্ত তারা কোন অবৈধ কাজ না করে এবং গণিকাবৃত্তিতে না জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেনীর ব্যক্তি হচ্ছে তারাই যারা অনৈতিক উদ্দেশ্যে মেয়েলি আচরণ করে এবং তারা পাপী ।



ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে ইরানে সব থেকে বেশী রুপান্তরকামি অপারেশন করা হয়। তারা রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিকে যে কোন এক লিঙ্গে রুপান্তর হওয়ার সুযোগ দেয়।
২০১৬ সালে পাকিস্তানে ৩৪ জন আলেমের পক্ষ হতে একটি ফতওয়া দেয়া হয় যে, জন্মগতভাবে আন্তঃলিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হিজড়াদের মাঝে যাদেরকে শারীরিক পরীক্ষার দ্বারা আলাদাভাবে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে, তাদের মধ্যে বিপরীতকামী বিবাহ বৈধ। এমনকি সাধারণ মানুষও চাইলে তাদেরকে বিয়ে করতে পারবে।

হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত লিঙ্গ---
ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্ম হিন্দু ধর্ম। ভারতবর্ষে লিঙ্গ বৈষম্যের পাশাপাশি একদা বর্ণ বৈষম্য প্রবল ছিলো। হিন্দু ধর্ম চারটি বর্ণে বিভক্ত। ব্রাম্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। দক্ষিণ এশিয়ায় রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদেরকে সাধারনত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অঞ্চলভেদে ভাষাভেদে হিজড়াকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এই অঞ্চলে হিজড়াদেরকে সামাজিক ভাবে মূল্যায়িত করা হয়। তারা সমাজ থেকে দূরে বাস করতে বাধ্য হয়। বাজারে ভিক্ষাবৃত্তি, গণিকাবৃত্তিই তাদের প্রধান পেশা। হিন্দু দর্শনে রূপান্তরিত লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।
নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য সংবলিত এই শ্রেণীকে ‘“তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে’”।প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে এই ধরণের মানুষকে আলাদা ভাবে পুরুষ বা নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। তাদেরকে জন্মসূত্রে তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে গণ্য করা হতো। তাদের কাছে সাধারণ নারী পুরুষের মত ব্যবহার প্রত্যাশা করা হতো না। আরাবানী হিজড়ারা আরাবান দেবতার পূজা করে। অনেক মন্দিরে হিজড়াদের নাচের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন হিজড়াদের আশির্বাদ করার এবং অভিশাপ দেয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে।


খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত লিঙ্গ---
গ্রীক eunochos থেকে Eunuchs শব্দটি এসেছে। খ্রিষ্ট ধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট করে রূপান্তরিত লিংগের ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যদিও এখানে Eunuchs বলতে নপুংশক ব্যক্তি বোঝানো হয়েছে। বিবাহ এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রাক্কালে জেসাস বলেন, কিছু মানুষ জন্ম থেকেই Eunuchs, আবার কিছু মানুষ অন্যদের দ্বারা Eunuchs এ পরিণত হয় এবং আরো কিছু মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজদেরকে Eunuchs এ রূপান্তরিত করে।
২০০০ সালে ক্যাথলিক সম্মেলনের ডকট্রিন অফ ফেইথের উপসংহারে বলা হয়, চার্চের দৃষ্টিতে একজন মানুষ ট্রান্সসেক্সুয়াল সার্জিকাল অপারেশনের মাধ্যমে একজন মানুষকে শুধু বাহ্যিকভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। “ the transsexual surgical operation is so superficial and external that it does not change the personality. If the person was a male, he remains male. If she was female, she remains female.”
খ্রিস্টান ধর্মে একজন ইথিওপিয়ান ইনুখ সম্পর্কে আলোচনার কথা আছে। বিবাহ এবং তালাক নিয়ে উত্তর দেয়ার সময় যীশু এক পর্যায়ে বলেন, “কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম থেকে ইনুখ এবং আরো কিছু মানুষ আছে যাদেরকে অন্যেরা ইনুখ বানিয়েছে এবং আরো এক প্রকৃতির মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজেদেরকেই ইনুখ বানিয়েছে।" এখানে একজন ইথিওপিয়ান ইনুখকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হবে কিনা সেই বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
কিছু খ্রিস্টান সংঘ রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইউনিটারিয়ান একটি উদার ধর্মমত। তাদের মূল খ্রিস্টান ধর্মের সাথে যুক্ত। ১৯৭৯ সালে তারাই সর্বপ্রথম রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিদের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে।and the first to open an Office of Bisexual, Gay, Lesbian, and Transgender Concerns in 1973, ১৯৮৮ সালে উইনিটারিয়ান উইনিভার্সালিস্ট এসোসিয়েশান প্রথম একজন রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিতে মনোনীত করে।

 ২০০২ সালে শ্যন ডেন্নিসন প্রথম রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তি যিনি ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট মন্ত্রনালয়ে ডাক পান। ২০০৩ সালে ইউনাইটেড চার্চ অফ খ্রিস্ট সকল রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেয়। ২০০৫ সালে ট্রান্সজেন্ডার সারাহ জোনস চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ধর্মযাজক হিসেবে নিয়োগ পান।২০০৮ সালে ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চ জ্যুডিশিয়াল কাউন্সিল রায় দেন যে ট্রান্সজেন্ডার ড্রিউ ফনিক্স তার পদে বহাল থাকতে পারবেন। ঐ একই বছরে মেথোডিস্টদের একটি সাধারণ বৈঠকে একাধিক রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তি ক্লারজির বিরুদ্ধে পিটিশান খারিজ করে দেয়া হয়।



বৌদ্ধ ধর্মে রূপান্তরিত লিঙ্গ---
অধিকাংশ বৌদ্ধ লিপিতে ধর্ম প্রতিপালনে কোন লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন করা হয়নি। নির্বাণ লাভের জন্য কামনাকে এই শাস্ত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
লিখেছেন-অনুপমা সরকার

↑PREVIOUS-উমরের চুক্তি 

NEXT-রাজনীতিবিদগন এবং ধর্ম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ