এই ব্লগটি সন্ধান করুন

পরিত্রাণ

আজি এই ঘোর অমাবস্যার সন্ধ্যা তিথীতে বাবু দেবেন কুমার ভট্টাচার্যির মাথায় যেন নরক ভাঙ্গিয়া পরিতে চাহিলো। তিনি হইলেন মন্দিরের পুরোহিত, সন্ধ্যা আহ্নিক সারিয়া তিনি মন্দিরের মধ্যে বসিয়া ভগবত গীতা পাঠ করিতে ছিলেন।
মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের কার্যে জগাই বলিয়া এক লোক নিযুক্ত রহিয়াছিলো।

জগাই বলিয়াছিলো ঠাকুর কি বাটি ফিরিতে বিলম্ব করিবেন? তাহা হইলে সেই সময়ে আমি বাজার হইতে কতক ঘুরিয়া আসিতাম।
দেবেন ঠাকুর বলিয়াছিলো যা, কিন্তু অতি সত্তর চলিয়া আসিস, এদিকে রাত্র বাড়িয়া যাইতেছে।
জগাই বলিয়াছিলো তাই করিবো ঠাকুর , আমি কেবল পান তামুকটা লইয়াই চলিয়া আসিবো।


অতএব মন্দিরে পুরোহিত একাই রহিয়াছিলো । লন্ঠনের আলোয় তিনি বসিয়া গীতা পড়িতে ছিলেন। এমন সময় বাহির হইতে গোঙানির মত শব্দ ভাসিয়া আসিলো। কয়েক বার একই ধরনের শব্দ হওয়াতে, কোথা হইতে এরুপ বিকট শব্দ আসিতেছে দেখিবার ইচ্ছায় পুরোহিত হারিকেন লইয়া মন্দির হইতে বাহিরে আসিয়া এদিক ওদিক অবলোকন করিতে থাকিলেন। আরও কিছু দুর অগ্রসর হইবার পর তিনি যা দেখিলেন, তাহা দেখিয়া তাহার বুক ছ্যাত করিয়া উঠিলো।


বস্তার মতন কি একটা যেন মন্দিরের সিড়ির উপর পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা হইতেই এই বিকট শব্দের উৎপত্তি বলিয়া মনে হয়, তাহা আবার অনেকটা মানুষের কাঠামোর মতও ঠেকে।
দেবেন ঠাকুর আর একটু অগ্রসর হইয়া সিড়ি হইতে কয়েক ধাপ নিচে নামিয়া ভালো করিয়া অবলোকন করিয়া দেখিলেন যে, তাহা একটি মানুষের শরীরই বটে!


হঠাৎ শরীরটি নড়িয়া চড়িয়া উঠিয়া চিৎ হইয়া গেল। পুরোহিত ভয় পাইয়া এক কদম পেছনে সরিয়া আসিলেন।
এইবার মুখের উপর হারিকেনের আলো যাইয়া পড়িলো - দেবেন ঠাকুর আশ্চর্য হইয়া দেখিলেন - এ তাহাদেরই গ্রামের মুচি পাড়ার সাগর মুচি তাহার সামনে পড়িয়া রহিয়াছে।
এ কোথা হইতে কি ভাবে এখানে আসিয়াছে তাহা দেবেন ঠাকুরের জানিবার কথা নহে, তবে এই বৃদ্ধ যে গ্রাম হইতে কোথায় চলিয়া যাইয়া সেথায় ভিক্ষা করিতো, তাহা দেবেন ঠাকুর শুনিয়া ছিলেন।


এমনিতেই গাঁয়ে যদি কোন মুচির বসবাস থাকে, তাহা হইলে একেবারে গ্রামের প্রান্তসীমার দিকে হয় তাহাদের বসতি। সভ্য ভদ্র গ্রামীন সমাজ তাহাদের সম্পর্কে যথা কিঞ্চিৎই অবগত থাকেন।
এই অন্তজ সম্প্রদায়ের মানুষেরাও সভ্য সমাজের সহিত মেলামেশা করে না বলিলেই ভালো হয় । তাহাদের পল্লি, পালিত সুয়োর আর পৈত্রিক কর্ম লইয়া তাহারা সভ্য জগতের ভিতরে থাকিয়াও বহু বৎসর যাবত পৃথক হইয়া রহিয়াছে।
কোন সভ্য মানুষ ইহাদের কাছে আসে না, কেবল খ্রিস্টান মিশনারির লোক জন মাঝে মধ্যে খবর লয় , যথা কিঞ্চিৎ সাহায্যও বোধ করি করে , সেই কারনে এই শ্রেনীর মানুষ দ্বিগের পল্লি গুলি আজিকে খ্রিষ্টান পল্লিতে পরিনত হইয়াছে।


কিন্তু সমস্তটিই এখনও তাহা হইয়া ওঠে নাই।
ইহারা নিজেদেরকে হিন্দু হিসাবে ভাবিতো, কিন্তু ধর্মের চর্চা ইহাদের মধ্যে এক প্রকার নাই বলিলে চলে, বছরের মধ্যে একবার দূর্গা পূজা আসিলে এরা মন্দিরে যায়, দূর হইতে ঠাকুরকে দেখিয়া বাদাম মুড়ি খাইয়া চলিয়া আসে, ইহাদের মধ্যে ধর্মীয় কাজ ওই এতোটুকুই রহিয়াছে ।

কিন্তু দেবেন ঠাকুর মন্দিরের পুরোহিত, মানুষের বিভিন্ন রকম আপদে বিপদে তিনি একজন সাহায্যকারী এবং বন্ধুবৎসল মানুষ। সেই কারনে সমাজও তাহাকে মাথায় তুলিয়া রাখিয়াছেন । সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ লইয়া সেই কারনেই তাহার কারবার।
সেই সূত্রে দেবেন ঠাকুর এই সাগর মুচিকে চিনিলেন। দূর হইতে কয়েক বার তিনি নাম ধরিয়া ডাকিলেন। কাছে যাইয়া গায়ে হাত দিয়া ডাকিতে ইচ্ছা হইলেও তিনি তা পারিলেন না।

এখনও তিনি শরীরে পূজার পোষাক পড়িয়া আছেন, যে শীত পড়িতেছে তাহাতে এই বয়সে এত রাত্রে যাইয়া স্নান করিবার কাজও অসম্ভব হইয়া যাইবে। তিনি কি করিবেন বুঝিতে পারিলেন না, শুধু হারিকেন উচুতে তুলিয়া ধরিয়া জগাইএর আসিবার পথের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

আর এক বার বৃদ্ধ সাগর মুচি গুঙাইয়া উঠিলো, তিনি স্পষ্ট কানে শুনিলেন জল, লোকটি জল চাহিতেছে।দেবেন ঠাকুর এখন কি করিবেন, কোথায় জল পাইবেন, আবার কেমন করিয়াই বা তিনি এখন এই মুচিকে জল পান করাইবেন!
মন্দিরের ভিতরে কোথাও যে একেবারে জল ছিল না তাহা নহে , এক ঘটি গঙ্গা জল মন্দিরের এক কোণে রহিয়াছিলো, তাহা দেবেন ঠাকুর ভালোই জানিতেন। এদিকে মুমূর্ষু পড়িয়া থাকা দেহটি হইতে আরেক বার শব্দ ভাসিয়া আসিলো - জল,,,,

কয়েক বার দেবেন ঠাকুরের মনে হইলো , এই রাত্রে তিনি অপবিত্র হইয়া মন্দিরের গঙ্গা জল এই মুচিকে পান করাইবেন , কিন্তু কোথায় যেন বার বার তাহার চিন্তা গুলি বাঁধা পাইতে লাগিলো।
তিনি তারা ভরা আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া আর্তনাদ করিয়া কহিলেন - ভগবান এ তুমি আমারে কোন পরীক্ষায় ফেলিয়াছো , যদি ফেলিয়াছোই, তাহা হইলে ইহা হইতে উত্তরণের শক্তিও আমারে দাও।

ঠিক ভগবান উনার ডাক শুনিতে পাইয়া কিনা বলিতে পারিনে, কোথা হইতে জগাই যেন আসিয়া পরিলো। আসিয়া এই অবস্থা দেখিয়া জগাই প্রশ্ন করিলে দেবেন ঠাকুর তাহার সবিশেষ বৃত্তান্ত বলিবার পর কহিলেন , জগাই তুই এক দৌড়ে তোর বাটি হইতে এক ঘটি জল লইয়া আয়।
জগাই যাচ্ছি ঠাকুর বলিয়া দৌড়ে প্রস্থান করিলো।

কিন্তু এদিকে তখন বেশ কিছু কাল বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। জগাই জলের ঘটি এবং সাথে করিয়া জনা কতক লোক আনিয়া দেখিলো, জল যাহার জন্যে, সেই সাগর মুচি আর বাঁচিয়া নাই, তাহার প্রাণবায়ু দেহ হইতে বাহির হইয়া রাত্রের আমানিশার ঘোর অন্ধকারে মিলিয়া গিয়াছে।
দেবেন ঠাকুর কাঠের মূর্তির মতন মন্দিরের দরজার চৌকাঠে বসিয়া রহিলেন। সেই রাত্রে লোক জন দিয়া মৃত দেহ মুচি পাড়ায় পাঠাইয়া দেওয়া হইলো।


কেউ কিছিু বোঝেনায় , কেউ কোন সন্দেহ করেনাই , দেবেন ঠাকুর কোন অনুচিত কর্ম করিয়াছেন তাহা কেউ বলিবেও নহে।
বাস্তবিক জল যে চাহিয়াছিলো, তাহা কারো জানাও নাই ।
কিন্তু রাত্রে দেবেন ঠাকুরের ঘুম আসিলো না , রাত্রে তিনি বাটি ফিরিয়া জল খাবারও সারেন নাই।
তিন এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত হইলেন‌। বার বার মনে প্রশ্ন ভাসিয়া আসিতে থাকিলো যে, যখনই জল চাহিয়াছিলো যদি তখনই জল দেওয়া যাইতো, তাহা হইলে সে কি বাঁচিয়া যাইতো?
তিনি কি মনুষত্বকে অবমাননা করিয়া বসিলেন ? মানুষ হইয়া মানুষের কর্ম কি তিন করিতে পারেন নাই ?
আবার ভাবিতে থাকিলেন প্রানীর মরন তো মানুষের ইচ্ছায় নহে, ভগবানের ইচ্ছার বাহিরে কিছু কি হয় ? কিন্তু সাগর মুচিরও কি কম ভাগ্য যে মায়ের মন্দিরের সিড়িতে আসিয়া সে মরিতে পারিলো, একি ভগবানের ইচ্ছায় নহে !


কিন্তু বিবেক কোথায় যেন আঘাত করিয়া যায়!
সেই বিবেকের তাড়নায় পুরোহিত দেবেন ঠাকুর ঘোষনা করিলেন যে, সাগর মুচি যেহেতু মন্দিরের সিড়িতে আসিয়া প্রান ত্যাগ করিয়াছে, তাহা নিশ্চিত ভগবানের ইচ্ছায়, আর ইহাতে কোন সন্দেহ থাকিবার কিছু নাই। সাত জনমের ভাগ্যে কেউ এমন মরন পাইবে না।
তাহার সৎকারের সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিলেন। তাহার পরিবার কয়েক পালি ধান , কয়েক কলসি গুড় আর পুরোহিত হইতে একটি ছাগল পাইলেন।
আর দশ জন মুচির চাইতে সাগর মুচির সৎকার ব্যতিক্রমী ভাবে হইলো ।
চারি দিকে দেবেন ঠাকুরের মহানুভবতায় ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। সমাজ বাচিলো, সংস্কার বাচিলো , কেবল বাচিলো না সাগর মুচি।
লিখেছেনঃ আবু জাহেদ


↑PREVIOUS-ধর্ম বিষয়ে আমার প্রশ্নগুলো প্রথম পর্ব

NEXT-একটু ইসলাম প্রীতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ